শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইসলামবিদ্বেষ, করোনা এবং আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্দশা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫৩ পিএম

চীনের ওহান থেকে ইতালি হয়ে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর এপিসেন্টার হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে শুরুতে পাত্তা না দিয়ে অনেক বড় ভুলের খেসারত দিলেও যখন বিষয়টি বুঝতে পারলেন তখন অনেকটা পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজ দেশের মানুষকে বাঁচাতে তার আন্তরিকতা ও চেষ্টার কোনো কমতি না থাকলেও দূরদর্শী নেতৃত্বের দক্ষতা ও প্রজ্ঞা না থাকার খেসারত শুধু মার্কিন জনগণকেই দিতে হচ্ছে না, প্রকারান্তরে পুরো বিশ্বকেই দিতে হচ্ছে। মাস্ক পরা, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস নিয়ে চীনের দিকে ব্লেইম গেম এবং সর্বশেষ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উপর চড়াও হওয়া এবং সংস্থার চাঁদা বন্ধ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্তে ট্রাম্পের গোয়ার্তুমিই ফুটে উঠেছে। ওহানে করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী চরিত্র ফুটে উঠার পর তা দ্রুত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার সময়টাতে মার্কিনীরা প্রস্তুতি গ্রহণের অনেকটা অবকাশ পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এন-৯৫ মাস্ক, পিপিই, প্রয়োজনীয় ওষুধ, অক্সিজেন বোতল, ভেন্টিলেটরের যোগান দিতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর দৃশ্য নিরব দর্শকের মতো দেখতে হয়েছে। বিশ্বের একনম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির জন্য এ এক অভাবনীয় শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা। কোনো দৃষ্টান্ত বা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই দুই মাসের মধ্যে চীন মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও চীনের দৃষ্টান্ত ও অভিজ্ঞতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার পারদ যখন ক্রমেই নিম্নমুখী, তখন তিনি করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে পুরনো কায়দায় চীন বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী খেলায় লিপ্ত হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন তার মুখরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে ট্রাম্প আবার চীনের সাথে বৈরিতার পাশপাশি মুসলিম বিদ্বেষী ইসলামোফোবিক মনোভাবের জানান দিচ্ছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতারাও করোনাভাইরাস নিয়ে একপ্রকার পরিকল্পিত ইসলামবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভারতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। দিল্লিতে মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হওয়া করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতা এবং অর্থনীতি ধসে পড়ার হতাশাকে মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গার রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি। ভারতে করোনা মহামারীর সতর্কতা জারির পরও সেখানকার বেশ কয়েকটি হিন্দু ও শিখ মন্দিরে বড় গণজমায়েতের ঘটনা ঘটেছে। একইভাবে মুসলিম তবলিগ জামায়াতের একটি জমায়েতকে ঘিরে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে নির্বিচারভাবে মুসলমানদের দায়ী করে ব্যাপক প্রপাগান্ডা মেশিনারিজ সক্রিয় করে তুলেছে। এই প্রপাগান্ডার কারণে শত শত মুসলমান পরিবার সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ, নির্যাতন এমনকি বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো পরিস্থিতির শিকার হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে ভারতের মুসলমান নেতা এবং সাধারণ নাগরিকরা হিন্দুত্ববাদীদের ফাঁদে পা দেয়নি। তারা ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরনো সামাজিক-ধর্মীয় মূল্যবোধে যখন চিড় ধরেছে, সংক্রমণের ভয়ে মুমূর্ষু প্রিয়জনদের একাকী ঘরে, কোথাও কোথাও রাস্তায় বা জঙ্গলে ফেলে আসার ঘটনাও ঘটছে। মৃতের সৎকার বা দাফনেও প্রিয়জনরা উৎসাহ দেখাচ্ছে না। তবে মৃত গরুর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় হাজার মানুষের সমাগমের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে উত্তর-পূর্ব ভারতে বেশ কয়েকটি স্থানে মৃতদের করোনা রোগী সন্দেহে পরিবারের লোকজন বা প্রতিবেশীরা লাশ ফেলে পালিয়ে গেছে তখন ভিন্ন পাড়ার মুসলমান যুবকরা হিন্দুর লাশ সৎকারের উদ্যোগ নিয়েছে। মুসলমান যুবকরা লাশ শ্মশানে নিয়ে দাহ করার ব্যবস্থা করেছে। এটি ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত, যেখানে মুসলমানরাই সৌহার্দ্যের বারতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। একইভাবে ভারতের জাতীয় রাজনীতির ক্ষমতাসীনরা যখন মুসলমানবিদ্বেষী শ্লোগান তুলে জাতিকে বিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত, তখন শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনের মুসলমানরা উদার মানবতাবাদী ভূমিকা নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন। করোনা মহামারীর লকডাউনে শতকোটি মানুষের দেশ ভারতের জাতীয় অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষকোটি রুপির প্রণোদনা-সহায়তার ঘোষণার পাশাপাশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধনী ও সামর্থ্যবানদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে, সেখানেও মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। ভারত তথা এশিয়ার শীর্ষ ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানী যখন করোনা ত্রাণ তহবিলে ৫০০ কোটি রুপি সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে আইটি মোগল আজিম প্রেমজির পক্ষ থেকে হাজার কোটি রুপির সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাসট্রির মুসলমান তারকারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদারভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বৃটেনে করোনাভাইরাসে ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্যসেবায় এশিয়ান তথা ইমিগ্র্যান্টরা সেবা ও ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একই অবস্থা নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটনেও। সেখানে শত শত অশ্বেতাঙ্গ, আফ্রো-এশিয়ান ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী জীবন বাজি রেখে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের সেবা দিয়ে চলেছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে ত্যাগের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এরপরও ডোনাল্ড ট্রাম্পদের মুখে ইসলামোফোবিক বক্তব্যই উঠে আসছে শুধুমাত্র জাতিকে বিভক্ত করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য। একইভাবে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের শাসকরাও শ্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অশান্তি ও বিভক্তির রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর এই বৈশ্বিক দুর্যোগে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ আঞ্চলিক ও আন্তঃসীমান্ত সংঘাত বন্ধে সম্মত হয়েছে। ইরান, তুরস্ক থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত অনেক দেশের শাসকরা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন আছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি জায়নবাদী ইসরাইল এবং অধিকৃত কাশ্মিরিদের প্রতি ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা অসহায় বন্দি মুসলমানদের করোনাভাইরাসের মহামারীর মুখে ঠেলে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতেই যেন আগ্রহী। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দাবি জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু এই মহাদুর্দিনেও সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের মুসলমানদের মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিতে নারাজ। অথচ মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির লড়াই থেকে শুরু করে প্রতিটি জাতীয় দুর্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বিলগেটস, ওয়ারেন বাফেটদের মতো ধনকুবের করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা ও ভ্যাকসিন তেরীর গবেষণায় বিলিয়ন ডলারের সহায়তা তহবিল মেলে ধরেছেন একইভাবে ভারতের আম্বানি, আজিম প্রেমজিদের পাশাপাশি শাহরুখ-সালমান খানরাও উদারভাবে এগিয়ে এসেছেন। সেখানে বাংলাদেশের ধনকুবের ও শিল্পগ্রুপগুলোকে তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষকোটি টাকার প্রণোদনা ও উদ্ধার তহবিল ঘোষণার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক ও শিল্প গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য চেক হস্তান্তরের দৃশ্যও গণমাধ্যমে দেখা গেছে। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে তাদের কনভেনশন সিটিতে হাজার শয্যার করোনা আইসোলেশন সেন্টার ও হাসপাতালের জন্য খুলে দেয়ার ঘোষণা শোনা গেছে, কাজও অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় ধরে যে সব শিল্প গ্রুপ দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের লক্ষকোটি টাকার টেন্ডার পেয়ে লাভবান হয়েছে, যারা আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের মতো বছরান্তে পুরনো বড় ব্যাংকগুলোর শেয়ার কিনে এবং নতুন নতুন ব্যাংকের মালিকানা করাত্ত করার পাশাপাশি বিদেশে কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেছে, এই বৈশ্বিক দুর্যোগে সে সব কোম্পানির মালিকদের দেখা যাচ্ছে না কেন? এই দুর্দিনে তাদের নিরবতা-নিষ্ক্রীয়তা বা অপ্রতুল ভূমিকা কাম্য নয়। নির্বাচনের আগেও পরে সরকারিদলের একশ্রেণির এমপি-মন্ত্রীর সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালেন্সে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যৌথবাহিনীর অভিযানে জিকে শামীম, খালেদ মাহমুদ, ইসমাইল হোসেন সম্রাট বা এনু-রুপনসহ হাতে গোণা কয়েকজনের কাছ থেকে নগদ শত শত কোটি টাকা জব্দ করার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এদের অনুদঘাটিত অস্থাবর ও পাচার করা সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায়নি। তারা মধ্যম সারির নেতা, তাদের গডফাদারদেরকেও অভিযানের আওতায় নিয়ে আসার গণদাবি উঠেছিল। এই সময়ে করোনাভাইরাস মহামারীতে ব্যবসায় ও কর্মসংস্থান বন্ধ থাকায় দেশের কোটি কোটি মানুষ নিঃস্ব হতে চলেছে। লাখ লাখ পরিবারের খাবারসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ রাষ্ট্রের নেই। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় জিরো থেকে হিরো বনে যাওয়া অবৈধ উৎসের সেই সব শত-হাজার কোটি টাকার সম্পদ এখন আর্তমানবতার সেবায় এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ের সংকট উত্তরণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দুইমাসের বেশি সময় ধরে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার অব্যাহত গতিতে বেড়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ইতোমধ্যে পৌনে লাখে পৌঁছেছে। ইউরোপের ইতালি, স্পেন, বৃটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষাধিক। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনায় মৃত্যুর মিছিল যখন কিছুটা স্থিমিত হয়ে এসেছে, ঠিক তখন বাংলাদেশে মহামারীতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। ট্রিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম এবং প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য-বাসস্থানসহ সব রকম সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সে সব দেশ লকডাউন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিং নির্দেশনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাস মহামারীর নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ আন্দাজ করতে পারছে না। এই করোনাভাইরাস মহামারীতে ইউরোপ-আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন জনগণের কাছে, বিশ্বের কাছে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার ইস্যুগুলো নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য ধনী-দরিদ্র রাষ্ট্রের ভেদাভেদ থাকা সমীচীন নয়। চীনের পর ইতালি ও স্পেনে করোনাভাইরাসে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল শুরু হওয়ার পর পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে বাংলাদেশে করোনা মহামারীর ভয়াবহতার আশঙ্কা করে সতর্ক করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারীর শুরু থেকে একমাসে ৬ লক্ষাধিক মানুষ বিদেশ থেকে যাতায়াত করলেও এদের শতকরা একভাগেরও করোনা পরীক্ষা করা হয়নি। এভাবেই ভাইরাস বহনকারী অচিহ্নিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সারাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে সামাজিক সংক্রমণের সৃষ্টি করেছে। লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক সংক্রমণ রোধ করতে হলে সংক্রমিত রোগীদের চিহ্নিত করা প্রথম শর্ত। এ ক্ষেত্রে লাখ লাখ মানুষকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আওতায় এনে দু’তিন মাসের মধ্যে সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার পন্থা গ্রহণ করে সুফল পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি। বাংলাদেশে লকডাউনের সময় কমিয়ে আনতে হলে প্রতিদিন একলাখ মানুষকে ভাইরাস পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রথম মৃতুর পর দেড়মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও করোনা পরীক্ষার হার সারাদেশে দিনে তিনহাজারও অতিক্রম করেনি। অন্যদিকে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে কর্মহীন, আয়বঞ্চিত লাখ লাখ পরিবারের খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা পূরণ ছাড়াই সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন অসম্ভব। এভাবেই বেড়ে চলেছে সামাজিক সংক্রমণ, মৃত্যু এবং অপ্রস্তুত, অপ্রতুল অথর্ব স্বাস্থ্যসেবা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর, গণমাধ্যম, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের চলমান ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে চলা দুর্নীতি-লুটপাট ও অব্যবস্থাপনা হঠাৎ করে আবির্ভূত বৈশ্বিক মহামারীর দুযোর্গের সময় দূর করা সম্ভব নয়।
করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর থেকে দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থা, ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ভগ্নদশা, অসহায়ত্ব ও করুণ মৃত্যুর কাছে মানুষের নিরব আত্মসমর্পণের দৃশ্যই ফুটে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের দৈন্যদশা প্রকাশ পাচ্ছে সেখানে আমাদের দেশের মন্ত্রী-আমলারা যেন মওকা পেয়ে গেছেন। তারা এখন বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে আমাদের অবস্থা অনেক ভালো। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যখাতে প্রতি বছরের হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ যদি যথাযথভাবে ব্যয় করা হতো, শত শত কোটি টাকায় নির্মিত অবকাঠামো, বিদেশ থেকে আমদানি করা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি যদি নষ্ট-অকেজো করে সাধারণ মানুষকে বেসরকারি হাসপাতাল ও বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা না হতো, যদি হাসপাতালের জন্য ১০ হাজার টাকার পর্দা ৩৬ লাখ টাকায় কেনার মতো ঘটনা না ঘটত তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত বৃটেন-আমেরিকার চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে থাকার কারণ ছিল না। এই মুহূর্তে বৃটেন-আমেরিকার হাসপাতালগুলোতে ডজন ডজন বাংলাদেশি ডাক্তার ও নার্স জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। আমাদের হাসপাতালগুলোতে বৃটিশ-আমেরিকান ডাক্তার দু-চারজন আছেন কিনা আমার জানা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হয়। দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় ওষুধের শতকরা ৯৭ ভাগের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাক নির্মাতারা ইউরোপ-আমেরিকার চাহিদা পূরণ করছে, সেখানে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিইর চাহিদা পূরণ করা কোনো বড় বিষয় ছিল না। দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র করোনাভাইরাস টেস্ট কিট তৈরির উদ্যোগ নেয়ার আগেই চীন থেকে হাজার হাজার টেস্ট কিট এসেছিল বলে জানা যায়। আর করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে ওষুধটির কথা ইতোমধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত ও পরীক্ষিত হয়েছে তার নাম হাইড্রোক্সিক্লোরিকুইন। বাংলাদেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি এই ওষুধটি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করে বাজারজাত করছে। আমেরিকায় করোনাভাইরাসে মৃত্যুর মিছিল শুরু হওয়ার পর অসহায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কাছে চিকিৎসা সহায়তা চেয়েছেন। বিশেষত ভারতকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ পাঠাতে নরেন্দ্র মোদিকে বাধ্য করেছেন ট্রাম্প। বাংলাদেশ কীভাবে সে অনুরোধে সাড়া দিয়েছে তার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসলেও তখন থেকে দেশীয় কোম্পানির হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধটির সরবরাহ অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়। করোনা পজেটিভ অনেক রোগী ব্যক্তিগত আগ্রহে দেশে বিভিন্ন ব্রান্ড নামে প্রচলিত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও এজিথ্রোমাইসিন ব্যবহার করে সুফল পাওয়ার খবর দিয়েছেন। এভাবেই ভেতরে ভেতরে ওষুধটির চাহিদা দেখা দিলেও দেশের করোনা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের নিরবতার কারণ বোধগম্য নয়। দেশে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসা সেবার নানাবিধ অব্যবস্থা, সীমাবদ্ধতা ও বেহালদশা থাকলেও হাইড্রোক্সিক্লোরিকুইনের উৎপাদন সক্ষমতা এ ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হতে পারত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মার্কিন ও কানাডিয়ান কর্মকর্তারা করোনা চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা সম্পর্কে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশে এ সম্পর্কে তেমন কোনো কথাই শোনা যায়নি। কেন? সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও কর্তৃপক্ষই এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন। তবে মালয়েশিয়ার অনুরোধে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন রফতানির উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২৩ এপ্রিল, ২০২০, ১২:২৬ পিএম says : 0
Bangladesh is not a poor country. Why we are poor?????, because government are monoster, they have looted our billiion billion dollar and they have taken our money to foreign countries. They don't know how rule a country, They knows only to kill people/forced disappearance/lodge false case, extortion money from every corner from our country.. they are carrying out so many criminal activities, if were to list it will become an encyclopedia.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন