সরকারের বিভিন্ন মহল জনগণকে আশার বাণী শোনালেও বাস্তবে জনমনে ভীতিই ছড়িয়ে পড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বা সাধারণ ক্ষেত্রেই নয় বরং দেশের বাইরেও পড়ছে। এনিয়ে প্রকাশিত খবরাদিতে দেখা যাচ্ছে, ভাষা ও শব্দ বদলালেও প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হচ্ছে সন্ত্রাস, জঙ্গি গ্রেপ্তার, আস্তানার খোঁজ ইত্যাদি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীদের উপর জঙ্গিরা যে কোন সময়ে হামলা চালাতে পারেÑ এমন আশংকা প্রকাশ করে তাদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এ বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। বার্তায় সালাম জানিয়ে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী যে কোন সময়ে যেকোন মন্ত্রীর উপর জঙ্গি গোষ্ঠী হামলা চালাতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছি। অনুগ্রহ করে সতর্ক থাকবেন এবং আপনার গানম্যান ও নিরাপত্তা দলকে বিষয়টি অবহিত করবেন। এপ্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপর হামলা হতে পারেÑ এমন তথ্য দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভার সব সদস্য ছাড়াও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সতর্কভাবে চলাফেরার জন্য বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত গানম্যান ও হাউজ গার্ডকে সতর্কাবস্থায় থাকার জন্য ব্রিফিং করা হয়েছে। এর আগে ১১ জুলাই সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ ভ্রমণে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে নাগরিকদের। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে। গত কয়েকটি হামলায় দেশের নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়ামের সাবেক শিক্ষার্থীদের নাম জড়িয়ে পড়ার কারণে এসব নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এখন মারাত্মক ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে।
আতংক এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এখন নানা মাত্রিকতায় উন্নীত হয়েছে। একদিকে পুলিশি হয়রানির ভয় অন্যদিকে হারিয়ে যাবার ভয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভবিষ্যতের চিন্তা। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর থেকে এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিকে নস্যাৎ করতে সরকার থেমে থেমে যে ধরনের অভিযান পরিচালনা করে আসছে, তাতে মূলত ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং বাণিজ্য আর সেই সাথে হয়রানি ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। অভিযোগ বিবেচনার আগেই কথিত ক্রসফায়ারসহ নানা কিছু এখনো ঘটমান। মাত্র সেদিন ঈদের আগে যে কথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে, দেখা গেল সরকারি ভাষ্যে ১৪ হাজার গ্রেপ্তার হলেও সরকারি ভাষ্যেই জঙ্গির সংখ্যা বলা হয়েছে মাত্র ১৯৪। যেকোন বিবেচনাতেই এটা নগণ্য। তাহলে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অবস্থা কি? এবারেও আবার অভিযান পরিচালনার কথা বলা হচ্ছে। অনুমান অসংগত নয় যে, একই ধরনের ধরপাকড় অব্যাহত থাকবে। বাস্তবতা হচ্ছে যে জঙ্গিদের ধরার নামে এসব অভিযান পরিচালিত হচ্ছে তাদের অভিযান কিন্তু শুধু বহালই নয়, বরং আরো বাড়ছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে স্বীকার করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে দিনদিনই পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করছে। গত রোববারে একদিনের খবর হলো জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় রংপুর আদালত পাড়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে, পদ্মাসেতু প্রকল্প জঙ্গি হামলার টার্গেট হতে পারে, মন্দিরে একজন সেবায়েতকে গলা কেটে হত্যার হুমকি। বলা হচ্ছে, হামলার আশংকায় খুলছে না ঢাকার কয়েকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, গুলশানের পিংকসিটিতে আতংক। এদিকে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের সার্কুলারে বলা হয়েছে, জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার প্রমাণ পাওয়া গেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হবে। এধরনের ঘটনাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সাথে ইউজিসি চেয়ারম্যানের বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকার জন্য বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজন কাউকে ক্যাম্পাসে বা আবাসিক হলে দেখলে তাকে পাকড়াও করতে বলা হয়েছে। যেহেতু সন্দেহের তালিকা বা সন্দেহভাজন মনে হবার বিষয়টি অনেকটাই আপেক্ষিক। তাই এর নেতিবাচক প্রভাব কতটা হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা না করে অভিজ্ঞতার উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম। এসব সিদ্ধান্তের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর যে পড়বে না তাতো জোর দিয়ে বলা যায়না। তাদের শিক্ষার ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে সে ভাবনাও আতংকিত করছে অভিভাবকদের। আতংক নিরসনে গুলশানের কূটনৈতিক এলাকা থেকে রাজনৈতিক দলের অফিস উচ্ছেদসহ আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে প্রকাশিত খরবাদিতে বলা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যখন হামলা হচ্ছে তখন একরকম কথা বলা হচ্ছে, আবার হামলার পরবর্তীতে অন্যরকম বলা হচ্ছে। এই বলা হচ্ছে হামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের জানা ছিল আবার বলা হচ্ছে ধারণা ছিল। একবার বলা হচ্ছে, বিদেশী জঙ্গি আবার বলা হচ্ছে দেশী জঙ্গি, সেও নানা আলোচনা। এদিকে এসব হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ যেমনি বাড়ছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যও লাটে উঠতে শুরু করেছে। দেশের বৈদেশিকমুদ্রা অর্জনকারী অন্যতম প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প ইতোমধ্যেই বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। আস্থার সংকট ক্রমশঃই ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ছেলের জন্য পিতা-মাতার, বাবার জন্য সন্তানের, স্বামীর জন্য স্ত্রী’র উদ্বেগ প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে। যে সন্তানটি শিক্ষায়তনে যায় সে ফিরে না আসা পর্যন্ত অভিভাবকের যে উৎকণ্ঠা, শংকা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আগেও ছিল, তবে এখন যে অবস্থা তা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। শিক্ষা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে যতটুক ুঅগ্রগতি হচ্ছিল তাও রুদ্ধ হতে বাধ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না দেশটা এমনতর ছিল না। কেন এমন হয়েছে, তার বিশদ আলোচনার চেয়ে এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ ও পদ্ধতি নিয়ে ভাবা জরুরী। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মূলকথা হচ্ছে, সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাদির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য যত মহতই হোকÑ বাস্তব অবস্থা হচ্ছে তাতে জনমনে আতংক-আশঙ্কা আরো বাড়ছে। সে কারণেই পরিস্থিতি উত্তরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন