বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ধর্মীয় শিক্ষা ও পারিবারিক মূল্যবোধের তাগিদ

প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সমস্যা দূর করতে সন্তানদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। একই সঙ্গে পরিবারের পিতা-মাতাদের তাদের উঠতি বয়েসী সন্তানদের আরো বেশী সঙ্গ দিয়ে তাদের মনের কথা শোনা ও বুঝার আহ্বান জানিয়েছেন। এতদিন দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের জন্য মাদরাসা শিক্ষার উপর দোষারোপ করেছেন। যদিও এ যাবৎ কোন জঙ্গিবাদী ঘটনায়ই কোন মাদরাসা এবং মাদরাসা শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং সাম্প্রতিক ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোতে ইংরেজী মাধ্যমের নামী-দামী স্কুল ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততার কথা শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ চলমান সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের শেকড় ধর্মীয় শিক্ষায় নেই, অন্য কোথাও বিদ্যমান। বিশেষত, আধুনিক নাগরিক জীবন ধারায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অনলাইন, মোবাইল গেজেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করে তুলছে। পক্ষান্তরে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কেউ যে কোন উগ্রবাদী সংগঠন, ভ্রান্ত মতবাদ ও শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। পেশা ও বিত্ত-বৈভবের মোহে অতি ব্যস্ত পিতা-মাতারা সন্তানদের শিক্ষা ও জীবনযাত্রার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করলেও তারা তাদের সময় বা সঙ্গ দিতে পারছেন না। তাছাড়া পরিবারের সদস্যরা যার যার মত স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে বুঁদ থাকার কারণে একই ছাদের নিচে থাকার পরও পরস্পরের মধ্যে এক ধরনের এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় শিক্ষা এবং পারিবারিক বন্ধনকে আরো সুসংহত করা গেলে সন্তানের বিপথগামিতা রোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব।
বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানরা হাজার বছর ধরে নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ অটুট রেখেই শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। শত শত বছরের সুলতানী ও মুঘল শাসনের সময়ও কোন ধর্মীয় জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস নেই। সারাবিশ্বে চলমান সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে নানাবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াবলী জড়িত রয়েছে। এক অর্থে এ সমস্যা এখন আর কোন দেশের একক সমস্যা নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে দেশীয় বাস্তবতা বা আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও জাতিগত বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের থাবা বিস্তার করে থাকে। বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা, টার্গেট কিলিং, নাশকতা ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার জন্য গত কয়েক বছর ধরেই সরকার ও রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পরের উপর দোষারোপ করে আসছে। ব্লেইম গেমের এই অপরাজনীতির কারণে প্রকৃত জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যর্থ হওয়ায় সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী চক্র তাদের বিষাক্ত থাবা ক্রমে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছে। অনেক দেরীতে হলেও তরুণ সমাজের বিপথগামিতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ে তাদের জড়িয়ে পড়ার সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসমুখের দিকে দৃষ্টি পড়েছে দেশের সরকার প্রধানের। ধর্মীয় শিক্ষা এবং পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় ও অর্থবহ করে তোলার প্রয়োজনীয়তার এই উপলব্ধি সমাজে একটি ইতিবাচক আবহ সৃষ্টি করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। ধর্মীয় শিক্ষা না থাকলে ধর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা অনেক সহজ। বিশেষত, ইসলামের অপব্যাখ্যা করে একটি পক্ষ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একদিকে মুসলমান তরুণদের সহজেই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে, অন্যদিকে এসব সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী কর্মকা-কে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি ছড়াচ্ছে।
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক আগ্রাসন ও টার্গেট কিলিং কোন কাজে আসেনি। আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহল মুসলিম বিশ্বের বিক্ষুব্ধ তরুণদের সহজেই জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। গতানুগতিক নিরাপত্তা প্রযুক্তি, পুলিশি ও সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছেনা। এ কারণেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কারণসমূহ নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ইসলামসহ সব ধর্ম শান্তির কথা বলে এবং ধর্মীয় শিক্ষাকে কাজে লাগানোর কথা বলা হলেও বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিবর্তনে কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। গুলশানের হলি আর্টিজান এবং শোলাকিয়া ঈদের জামায়াতের কাছে সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সাথে আইএসসহ আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকটা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর দেশের সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই জাতীয় ঐক্যের আহ্বান শোনা যাচ্ছে। জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার রাজনৈতিক উদ্যোগটি সরকারের কাছ থেকেই আসার কথা থাকলেও সে উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছেনা। মূলত, দেশের রাজনৈতিক অনৈক্য ও অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়েই জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা তাদের ছক তৈরী করেছে এবং পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতিতে তারা দীর্ঘদিন নিজেদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অথচ জঙ্গিবাদ উদ্বুদ্ধকরণের অভিযোগে ইতিমধ্যে সেটেলাইট চ্যানেল পিস টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি জুমার খুতবায় সরকারী নিয়ন্ত্রণের বিতর্কিত সিদ্ধান্তও এসেছে। এসব সিদ্ধান্ত অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। এসব লক্ষ্য অর্জনে কতটা সফল হওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এসএসএফ’র ৩০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা কারিকুলাম সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে হবে। সেই সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দূর করার কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

 

 

 

***********

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন