অনেক চড়াই-উতরাই ডিঙিয়ে আমাদের তৈরি পোশাক খাত তার প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষত ২০১৩ সালে রানাপ্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত হঠাৎ করে যে অস্বাভাবিক চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হয়েছিল দেশের শিল্প-উদ্যোক্তারা তার অনেকটাই সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন। সস্তায় প্রচুর দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ এবং প্রতিযোগিতামূলক কম দামে মানসম্পদ পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা ধরে রাখতে পারায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব হচ্ছে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের এই ধারাবাহিক সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি কেনিয়ার নাইরোবিতে বাণিজ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সাথে অনুষ্ঠিত এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থার (আঙ্কটাড) মহাসচিব ড. মুখিসা কিটুই বলেছেন, বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ অচিরেই প্রথম হবে। আঙ্কটাড মহাসচিবের এই প্রত্যাশা ও ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের লেদার, প্লাস্টিক, ওষুধশিল্প খাতসহ আন্তর্জাতিক রফতানি বাণিজ্যে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগসহ সামগ্রিক সহায়তার ইতিবাচক মনোভাব ও আশ্বাস পাওয়া গেছে আঙ্কটাডের পক্ষ থেকে। তবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর অনুকূল পরিবেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতসহ শিল্প খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার যখন বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে, ঠিক তখন সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী নাশকতার ঘটনাগুলো সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সম্ভাবনার পথকে দুরূহ করে তুলছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামায়াতের অদূরে সন্ত্রাসী হামলায় আইএস-সংশ্লিষ্টতার তথ্য এবং ১৭ জন বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। গুলশানে নিহত ৯ জন ইতালীয় নাগরিকের প্রায় সবাই বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অ্যাপারেল রফতানির সাথে জড়িত এবং নিহত ৭ জন জাপানি নাগরিক বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা-ে জাপানি সহায়তা সংস্থা জাইকার বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই ঘটনার পর জাইকা তার কর্মকর্তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। অন্যদিকে গুলশানে ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার আগে থেকেই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কয়েকটি পশ্চিমা দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে। কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশে তাদের কার্গো বিমান উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আশার কথা হচ্ছে, চলমান পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও ক্রেতাদের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ক সংগঠন অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে তাদের কর্মকা- অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তবে অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স বা আঙ্কটাডের সহযোগিতার আশ্বাসই যথেষ্ট নয়। তাদের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত রাখা সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রথম হওয়ার সম্ভাবনার যাত্রা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে বিশ্বের এক নম্বর তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ চীনে বাংলাদেশের অ্যাপারেল রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৯ ভাগ এবং জাপানে ১৮.৬৮ ভাগ। গত ৪ বছর ধরে চীন-জাপানে বাংলাদেশের অ্যাপারেল রফতানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া চীন-জাপান অ্যাপারেল সেক্টরের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশসহ এ খাতের সম্ভাবনাময় দেশগুলোতে স্থানান্তরের চিন্তা-ভাবনা করছে বলে অনেক দিন ধরে আলোচিত হচ্ছে। তবে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং প্রতিকূল বিনিয়োগ পরিস্থিতির কারণে ইতিপূর্বে অনেক বিনিয়োগ প্রস্তাবই ভেস্তে গেছে। পরিবর্তিত নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা না গেলে এ খাতের নিশ্চিত সম্ভাবনা আবারো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকারের সাথে সকল রাজনৈতিক পক্ষের সমন্বয়ে কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করার যে গণদাবি উঠেছে তা আর অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। শুধু পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা ও আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়তো সম্ভব নয়। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম সংবাদে বলা হয়েছে, ঢাকার অভিজাত এলাকাসহ সারাদেশে অভিযান ও তল্লাশির ফলে একপ্রকার আতঙ্ক ও গণদুর্ভোগের শিকার হচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ। গুলশান-বনানীর রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ধস নেমেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ ফাঁকা হয়ে পড়ার বিষয়টি দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করে। এরই মধ্যে জঙ্গি ধরার নামে যৌথ অভিযানসহ নানাবিধ উদ্যোগের কথাও প্রচারিত হচ্ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে এসব তৎপরতা গ্রহণ করা হলেও সত্যিকার অর্থে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস দমনে কতটা কাজে আসবে তা নিশ্চিত করা না গেলেও এসব তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশের বিনিয়োগ, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে অনেক বেশি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কিনা তা বিবেচনায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে পাটশিল্পের মতো অস্থিতিশীল পরিবেশ ও নাশকতার মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় খাতগুলোর বাজার ধ্বংসের ফাঁদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন