শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ

প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত বুধবার অনুষ্ঠিত একটি মত বিনিময় সভায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটভূমিকায় তার এ মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী। তিনি বলেছেন, জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। আজকে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, রাষ্ট্র বলে এক অদ্ভুত বিষয়কে চিন্তা করা হচ্ছে, যেখানে যারা ক্ষমতায় থাকবে শুধু তারাই মালিক থাকবে। অথচ বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের সংবিধান মোতাবেক জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিহিত রয়েছে জনগণের হাতে। সুলতানা কামালের মতে, এখন ব্যাপারটি হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। যারাই ক্ষমতায় থাকবে তারাই হবে রাষ্ট্রের মালিক। ক্ষমতাসীনদের বাইরে যারা আছে তারা, তার ভাষায়, অরাষ্ট্রীয়। ফলে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সুলতানা কামালের ভাষায়, জনগণের মধ্যে কেউ কেউ কখনো কখনো রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে আখ্যায়িত হন। অথচ একটি রাষ্ট্রের ১ নম্বর উপকরণ হলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সংজ্ঞাই মনে হয় বদলে ফেলা হয়েছে। এখন সরকার এবং রাষ্ট্রকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। যারাই সরকার তারাই যেন রাষ্ট্র। আর যারা সরকারের বাইরে তারা যেন রাষ্ট্রেরই বাইরে। এভাবে রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যে একটি বিভাজন রেখা টানা হচ্ছে। বিভাজন রেখা যতই প্রকট হচ্ছে ততই জনগণ সরকার থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। কোনো সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য এটা কোনো অবস্থাতেই সুফল বয়ে আনবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই সাবেক উপদেষ্টা আর একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, সরকারের বাইরে যে জনগণ রয়েছেন তাদের মধ্য থেকে অনেককে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি, অথবা রাজনৈতিক কর্মী অথবা কোনো রাজনৈতিক নেতা সরকার বিরোধী কথা বললেই তিনি রাষ্ট্রবিরোধী বা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। বর্তমান সরকারের আমলেও অনেক সরকারবিরোধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ অভিযুক্তদের একজনকেও রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে প্রমাণ করানো যায়নি। এটি প্রমাণ করা খুব দুরূহ। কারণ, কোনো ব্যক্তি সরকারবিরোধী হতেই পারে। তাই বলে তিনি রাষ্ট্রবিরোধী হবেন কিভাবে? এভাবে যুক্তি প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপ্রমাণিত অভিযোগ আনলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা নামক এই রাজনৈতিক পরিভাষাটি হালকা হয়ে পড়ে।  
চারটি উপাদান নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এগুলো হলো একটি ভূখ-, একটি জনগোষ্ঠী, একটি সরকার এবং তাদের সার্বভৌমত্ব। জনগণই যে রাষ্ট্রের মালিক  সেটি কোনো কথার কথা নয়। জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত হয় সরকার। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আইনসভা বা পার্লামেন্ট গঠন করে। ওই পার্লামেন্টে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তাদের মধ্য থেকে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ওই মন্ত্রিসভা একটি প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে। মন্ত্রিসভা এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামো মিলেই সরকার। রাষ্ট্রের থাকে তিনটি অঙ্গ। একটি হলো পার্লামেন্ট বা আইনসভা, আরেকটি হলো প্রশাসনিক কাঠামো এবং মন্ত্রিসভা মিলে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ এবং আরেকটি অঙ্গ হলো বিচার বিভাগ। দেখা যাচ্ছে যে, জনগণ, আইন সভা এবং সরকারের মধ্যে রয়েছে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দেখা যাচ্ছে, আইন সভা বা সরকার সব কিছুরই মূল হলো জনগণ। সেই জনগণকেই যদি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে।
সুলতানা কামাল তত্ত্ব কথার মধ্যেই তার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের বাস্তবতাকে এড়িয়ে গেছেন। কঠোর বাস্তব হলো, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারী যে নির্বাচন হয়ে গেলো সেটি দেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ভোটার সংখ্যার অবিশ্বাস্যরকম কম উপস্থিতি, তার ওপর আবার কারচুপি ওই নির্বাচনকে চরম বিতর্কিত করেছে। দেশী-বিদেশী সূত্র এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, ওই নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোটারও ভোট দেয়নি। পরবর্তীতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং সবশেষে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনও ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচনের মতোই হয়েছে। ফলে শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ঘটে নাই। এর অনিবার্য পরিণতি হলো সরকার থেকে জনগণের বিচ্ছিন্নতা। যেহেতু প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত এই জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এটিকে রাষ্ট্র থেকে জনগণের বিচ্ছিন্নতা বলে অভিহিত করা হচ্ছে। জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় জনগণ তাদের দাবি আদায় করতে গেলে নেমে আসছে নিপীড়ন। সরকারের এই নিপীড়ন নিয়ে দেশে তো বটেই, বিদেশেও কথা উঠেছে। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ সরকারের জুলুম-পীড়ন নিয়ে কথা উঠেছে। যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডসেও বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন নিয়ে তীব্র বাক-বিত-ার ঘটনা ঘটেছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জনবিচ্ছিন্নতার এ সমস্যার সমাধান হতে পারে একটি যথার্থ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার। এমন একটি সরকার যে প্রতিষ্ঠা করবে আইনের শাসন। আইনের চোখে সবাই সমান, এটি নিশ্চিত করতে পারলে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবে সরকার এবং সেই সুবাদে রাষ্ট্র।  

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন