শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বালা-মুসিবত, তাওবা-ইস্তিগ্ফার ও দোয়া-মোনাজাত

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০২০, ১২:০২ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নিবন্ধের প্রথম পর্বে আমরা কোরআন হাদীসের আলোকে বালা-মুসিবত আপতিত হওয়ার সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করেছি। দ্বিতীয় পর্বে তাওবা-ইস্তিগফারের বিষয় কিছুটা তুলে ধরেছি। এবার ৩য় ও ৪র্থ পর্বে দোয়া-মোনাজাত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব। মহান আল্লাহ তাওফিক দান করুন।
খোদায়ী গজব নাজিল হওয়ার মূল কারণ, খোদার নাফরমানী বা অবাধ্যতা। আল্লাহর হাবীব, রহমাতুল্লিল আলামীন, জিন্দানবী- হায়াতুন নবী এই পৃথিবীর বুকে মদীনায়ে তাইয়্যেবার পাক জমিনে শুয়ে আছেন তাই আল্লাহপাক তাঁর নাফরমানীর দরুণ আগের জমানার অবাধ্য জাতিসমূহকে যেমন চিরতরে নির্মূল, নিশ্চিহ্ন, বরবাদ করে দিয়েছেন। তেমনি আমাদেরকে ধ্বংস নিশ্চিহ্ন, নিস্তনাবুদ করে দেবেন না বটে তবে কখনো কখনো আমাদের সতর্ক ও সাবধান করে দেবার জন্য মহামারী, দৈব-দুর্যোগ পাঠাবেন, যাতে আমরা তাঁর দিকে ফিরে আসি, অনুতাপ, অনুশোচনা করি, তাওবা-ইস্তিগফার করি ও তাঁর দরবারে দোয়া-মোনাজাত করে বিপদ থেকে নাজাত চাই। এই দোয়া-মোনাজাত যেন কেবল নিছক আনুষ্ঠানিকতা না হয়। এ জন্য পবিত্র হতে হবে। অন্তকরণকে বিশুদ্ধ করতে হবে। সর্বন্তকরণে একনিষ্ঠভাবে ফরিয়াদ জানাতে হবে। বান্দা যখন সকল ভুলে একমাত্র আল্লাহমুখী হয়, আল্লাহ আর বান্দার মাঝে যখন আর কোনো কিছুর আড়াল না থাকে, পর্দা না থাকে, প্রতিবন্ধকতা না থাকে এমন হুজুরী কলবের দোয়াই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। মূলত আল্লাহ দেখেন দিল।
আধ্যাত্মিক কবি সম্রাট মাওলানা জালাল উদ্দীন রূমী রহ. তাঁর সুবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মসনবী শরীফে মসজিদে নবুবীর মোয়াজ্জিন হযরত বিলাল (রা.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। মসজিদে নবুবীর মুসল্লিদের আপত্তির কারণে একবার বিলালের (রা.)-এর পরিবর্তে অন্য কাউকে আজান দেবার দায়িত্ব দেয়া হলো। সে আজাদ দিলো, নামাজও জামাতের সাথে আদায় হয়ে গেল। পরক্ষণে হযরত জিব্রাঈল (আ.) অবতরণ করে নবীজী সা.-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসলূল্লাহ! আজ মসজিদে নবুবীতে কেন আজান হয়নি? নবীজী সা. বললেন কেন, আজ তো আরও বলিষ্ঠ কণ্ঠে আজান হয়েছে। দলে দলে মুসল্লিরা হাজির হয়েছে। যথারীতি নামাজের জামাতও অনুষ্ঠিত হয়েছে। জিব্রাঈল (আ.) বললেন, সে আজানের ধ্বনি তো আসমানে পৌঁছেনি। রূমীর ভাষায়, গোফতে হাতেফ বা আওয়াজ বাঙে বেলাল/খুরশিদে বর আরশে আরশে আলা জুললাল। বিলাল যখন আল্লাহতে নিবেদিত হয়ে মন-প্রাণ ঢেলে আজান দেয়, তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত সেই ধ্বনি সপ্ত আসমান ভেদ করে আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়। এটাই হলো কণ্ঠধ্বনি আর হৃদয় থেকে উচ্চারিত ধ্বনির মধ্যে প্রার্থক্য। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল লিখেছেন, ‘রাহগেয়ী হায় রসমে আজান রূহে বেলালী না রাহি/ফাল্সাকা ওয়ে রাহগেয়ী তালকীনে গাজ্জালী না রাহি’। আজান তো আছে সেই বেলালী রূহ কই? গাজ্জালীর দর্শন তো আছে, সেই গাজ্জালীর তালকীন-অন্তর কই। অন্যত্র কবি বলেছেন, আলফাজ ও মানীমে তাফাওত নেহি, লেকিন/মোল্লাকি আজান আওর মুজাহিদ কি আজান আওর। একই শব্দ, একই অর্থ কোনোই প্রার্থক্য নেই, তবু মোল্লার আজান আর মুজাহিদের আজান এক নয়, ভিন্ন। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে যখন কোনো পর্দা থাকে না, তখন ফরিয়াদ কবুল হয়ে যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবল্লিল ওয়ারিদ’- অর্থাৎ ‘আমি বান্দার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর’। সূরা ক্বাফ: ১৬।
অন্যত্র আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বলেন, ‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে (আমি কোথায়? আপনি বলে দিন) আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাকে সাড়া দেই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ সূরা বাকারা: ১৮৬।
আল্লাহ নিশ্চয়ই সাড়া দেন- যদি ডাকার মতো ডাকা যায়। সে ডাকে না থাকে যদি কোনো কৃত্রিমতা। সে ডাক উৎসারিত হতে হবে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। হতে হবে ভয়ভক্তি ও আবেগ মথিত।
রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ইন্নাল্লাহা লা-ইয়াস তাজিবু দোয়া আমিন ক্বালবি গাফিলিন লাআমরিন’- ‘উদাসীন অমনোযোগী ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না’। তিরমিজ, মিশকাত।
আল্লাহকে ডাকার মধ্যে থাকতে হবে একান্ত নিষ্ঠা গভীর আন্তরিকতা। শুধু ডাকলেই হবে না, একজন ভিক্ষুক তো সারাটা দিন একটা থালা পেতে আল্লাহ, আল্লাহ বলে ডাকে। সে তো শুধু পথিকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য, দু’একটা পয়সা পাওয়ার জন্য। তাই যদি না হতো তবে তো সে ওলী আল্লাহ হয়ে যেত, মানুষের কাছে আর হাত পাতার প্রয়োজন হতো না। একটা ছোট্ট কাহিনী দিয়ে কথাটা খোলাসা করা যায়। কাহিনীটা পৌরাণিক। এক বিশ্ব বিখ্যাত ধানুকির। সে ধনুর্বিদ্যা শেখার জন্য সে কালের বিখ্যাত এক গুরুর নিকট গেল। গুরু তাকে তীর জোড়ার কলা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে বললেন, বৎস, ওই দূরে, এক বৃক্ষের ডালে বসে আছে একটি বাজপাখি। তুমি দেখতে পাচ্ছ? হ্যাঁ, গুরুদেব। তুমি ধনুক হাতে লও, তীর জোড়। আর ওই বাজপাখির বাম চোখ বিদ্ধ কর। শিষ্য ধনুকে তীরজুড়ে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছে, তখন গুরুদেব বললেন, বৎস, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? শিষ্য বলল: গুরুদেব, দেখছি গাছ, গাছে ডাল, দেখছি ডালের উপর বসা বাজপাখি, তার মাথা, চোখ ইত্যাদি। গুরু বললেন, না বৎস, তোমার প্রশিক্ষণ পূর্ণ হয়নি। শুধু বাজপাখিটির বাম চোখ হতে হবে টার্গেট- একমাত্র লক্ষ্য। চলল আরও প্রশিক্ষণ। এবার পরীক্ষার পালা। এবারও গুরু দূরের গাছ ও বাজপাখি দেখিয়ে বললেন, ওর বাম চোখ বিদ্ধ কর। শিষ্য ধনুকে তীরজুড়ে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে গুরু থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি দেখছ বৎস? উত্তরে শিষ্য বলল, পাখিটির বাম চোখ। গুরু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, গাছ দেখছ? না। গাছের ডাল দেখছ? পাতা, দেখছ? পাখিটি দেখছ? পাখির মাথা দেখছ? শিষ্য সব প্রশ্নের উত্তরে না-ই বলে গেল। তোমার তীরের ফলা আর পাখির ঐ বাম চোখ ছাড়া মাঝখানে আর কিছু তো নেই। না, গুরুদেব, মাঝখানে আর কিছুই নেই। গুরু বললেন, বৎস এবার নিক্ষেপ কর তোমার তীর। ব্যর্থ হবে না। অবশ্যই লক্ষ্য ভেদ করবে। এরই নাম একাগ্রতা, একসুয়ী- জময়ে খাতের কল্লেহাল। নামাজ, রোজা, তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, জিকির-আজকার সব কিছুর পূর্ণ ফায়দা পেতে হলে এটা একান্ত প্রয়োজন। শুধু আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারেই নয়, জাগতিক কার্যাবলীতেও সফলতার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে পীর-মোর্শেদগণ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এর তালীম দিয়ে থাকেন। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই পবিত্র কালেমার প্রথম অংশকে নফী, আর দ্বিতীয় অংশ- অর্থাৎ ইল্লাল্লাহকে বলা হয় ইসবাত। এর জিকরকে বলা হয় নফী-ইসবাত। প্রথম নফীর অংশ এমনভাবে রপ্ত করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু অন্তরে আছে তা ঝেটিয়ে বিদায় দিতে হবে। হৃদয় এখন সব কিছু হতে মুক্ত- শূন্য। সাথে সাথে সেই শূন্য স্থানে ইসবাত অংশ উচ্চারণ করে সেখানে আল্লাহকে বসাতে হবে, স্থাপন করতে হবে। তরিকতের সাধনায় ও পরিভাষায় এ হলো- নাসিয়াম মানসিয়ান আমনান সিউআল্লাহ; তাজার রুদুল কালব আম্নান সিউআল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু আছে তা দূর করে কালব বা অন্তরকে আল্লাহময় করে তোলা। এভাবে বান্দা (ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত তো আদায় করবেই) নফল ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আল্লাহ বলেন, (হাদীসে কুদছি) (সে বান্দা) যে হাত দিয়ে ধরে আমি তার হাত হয়ে যাই, যে পা দিয়ে চলে আমি তার পা হয়ে যাই, যে চোখ দিয়ে দেখে আমি তার চোখ হয়ে যাই, সে যে কান দিয়ে শোনে আমি তার কান হয়ে যাই। তখন সে যা কিছু চায় আমি তাকে দান করি। আশ্রয় চাইলে আমি তাকে নিশ্চয়ই আশ্রয় দেই। বুখারী শরীফ। অর্থাৎ সে খোদায়ী শক্তিতে শক্তিমান হয়ে যায়, খোদায়ী বলে বলীয়ান হয়ে যায়। তাকে আল্লাহর অদেয় কিছু থাকে না। এ আলোচনা ভিন্ন এবং অনেক দীর্ঘ। আমরা এবার দোয়া ও মোনাজাতের আলোচনায় ফিরে আসি।
দোয়া হলো- ইবাদত, বরং সব ইবাদতের সার বা মগজ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমার কাছে দোয়া করো। আমি অবশ্যই তোমাদের দোয়া কবুল করব। যারা অহঙ্কারবশত আমার ইবাদত হবে বিমুখ, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ সূরা আল মুমিন: ৬০। [ক্রমশঃ]

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন