মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাকান্ড: অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি

ড. রাশিদ আসকারী | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০২০, ১২:০২ এএম

বর্তমান সময়ের এক নম্বরের সমস্যা কি জানতে চাইলে মনে হয় পৃথিবীতে একজনও মিলবে না যে করোনা সংক্রমণ ছাড়া অন্য কোনো উত্তর দেবে। হ্যাঁ, গ্রহণযোগ্য উত্তর একটাই। করোনাভাইরাস, যার অ্যাক্রোনিম হলো COVID-19 । CO হলো করোনা, VI ভাইরাস এবং D হলো ডিজিস। আর ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রথম সংক্রমণ সনাক্ত হয় বিধায় ১৯ সংখ্যাটি জুড়ে বসেছে COVID-এর সাথে। চীনের উহান প্রদেশে যাত্রারম্ভ করে এরই মধ্যে বিশ্বভ্রমণ শেষ করে ফেলেছে এই ভাইরাস। তান্ডব চালিয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশে; চালাচ্ছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এখন করোনা মানে এক মূর্তিমান বিভীষিকা। এর হাত থেকে নিস্তার মিলছে না রাজা-প্রজা, বাদশা-ফকির, ধনী-দরিদ্র কারুরই। মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীর দেশ এবং ভ‚খন্ড মিলে ২০১টি জনপদ।
মহামারী পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম নয়। মধ্যেযুগের শেষপাদে (১৩৪৬-১৩৫৩) বিউবোনিক প্লেগের দ্বারা সংক্রমিত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ দীর্ঘ সাত বছর ধরে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়াকে লন্ডভন্ড করে ফেলেছিলো। সর্বনিম্ন ৭৫ মিলিয়ন এবং সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন মানুষ সেই ভয়াল ‘কৃষ্ণমৃত্যুর’ শিকার হয়েছিলো বলে জানা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রাদুর্ভূত হওয়া ‘স্পেনিশ ফ্লু’ বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষকে সংক্রমিত করে ৫০ মিলিয়ন প্রাণ কেড়ে নেয়। মরণব্যাধি এইডসও বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ১৯৮১ সালের পর থেকে ৩৬ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। এছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা কেন্দ্রিক মহামারী যেমন ১৮৮৯ সালের ‘রাশিয়ান ফ্লু’, ১৯৫৬ সালের ‘এশিয়ান ফ্লু’ কিংবা ১৯৬৮ সালের ‘হংকং ফ্লু’ও কম বিপজ্জনক ছিলো না। অধিকন্তু, নিপা ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু, ডেঙ্গু কিংবা চিকনগুনিয়াকেও খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই। কিন্তু সব কিছুকেই যেনো ছাড়িয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস এবং তজ্জনিত বিরাজমান আতঙ্ক। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অন্তহীন অনিশ্চয়তার হাত থেকে রেহাই পেতে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন জার্মান অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার। ভয়াল করোনা কবলিত ইতালিকে রক্ষার সকল পার্থিব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আকাশের পানে হাত তুলে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন দেশটির অসহায় প্রধানমন্ত্রী জুসেপে কোনতে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা পৃথিবীর জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে। লকডাউন হয়ে পড়েছে সমগ্র মানবজাতি।
করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনমনে ভীতির প্রধান কারণ সম্ভবত এর অতি দ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা। এই সংক্রমণ হাঁচি-কাশির মধ্য দিয়ে তো বটেই, এমন কি কথা বলার মাধ্যমেও আক্রান্ত ব্যক্তির আপার রেসপিরেটরি ট্রাক্ট থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। আতঙ্কের দ্বিতীয় কারণ হলো, অদ্যাবদি করোনার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয় নাই। বাজারে ঔষধের বন্দোবস্ত থাকলে রোগীর মনোবল এমনিতেই চঙ্গা থাকে। কিন্তু করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব এতোটাই আকস্মিক যে, প্রতিরোধক এবং প্রতিষেধকবিহীন মানুষের ওপর এই প্রাণঘাতী আণুবীক্ষনিক শত্রু একতরফা দাপট খাটাচ্ছে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি শিশু এবং যুবাদের ওপর করোনার প্রকোট ততোটা প্রবল নয় বলে যে আশ্বাসের বাণী ছড়ানো হয়েছিল, তাও সর্বৈব অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশসমূহের ক্ষেত্রে যে সুবিধের কথা বলা হয়েছিলো, তাও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে থোড়াই কেয়ার না করে গৃষ্মমন্ডলীয় দেশসমূহেকে একের পর এক ধরাশায়ী করে ফেলেছে করোনাভাইরাস। বিশ্বের বড় বড় শহর একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ কিংবা কোলকাতা-ঢাকাকে ভর দুপুরে দেখলেও মৃতপুরি মনে হয়। এই কদিন আগে যে মানুষটি ঘড়ির উল্টোদিকে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো তার আজ সময় কাটে না। দেহঘড়ি ইউটার্ন নিয়েছে। ফেসবুকের ডান সাইড বারে সবুজ ফুটকিগুলো সারারাত সক্রিয় থাকে। ফলে মধ্যাহ্নে শয্যাত্যাগ। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ যুক্ত হয়ে ব্রাঞ্চে পর্যবসিত হওয়া। মোটকথা, করোনাকাল মানবজীবনকে একেবারে ওলটপালট করে দিয়েছে। ভীতি-আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার জালে আবদ্ধ সময়ই করোনাকাল।
যেহেতু কেবল মহামারীই নয়, বৈশ্বিক মহামারী (pandemic), তাই বাংলাদেশও এর আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ৮ মার্চ ২০২০-এ দেশের রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউট ইতালি ফেরত তিনজনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সন্ধান পায়। মার্চের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণের মাত্রা নিম্ন পর্যায়ে থাকলেও এপ্রিল পড়লেই তা ঊর্ধগামী হয়। মধ্যে এপ্রিলের পর এই উল্লম্ফনের মাত্রা আরোও বাড়তে তাকে। তবে ১৬০ মিলিয়ন মানুষের এই দেশে, যেখানে লকডাউন কিংবা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং পুরোমাত্রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না, কিংবা যেখানে লক্ষণাক্রান্তের তুলনায় টেস্টিং কিটসের পরিমাণ একেবারেই অল্প, সেখানে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ কষ্টকরই বটে। আর ঠিক সেখানেই সমস্যাটি জটিলতর হচ্ছে। করোনা মোকবেলার প্রথম অনিবার্য শর্ত হলো, আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতেই হবে। পরীক্ষা এড়ানো আক্রান্তেরা করোনাবাহক হিসেবে নির্বিঘ্নে করোনা সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটাবে। যে বিস্ফোরণকে পরিভাষাগতভাবে বলা যায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। লক্ষণাক্রান্তদের যথাযথভাবে পরীক্ষা করে ফলাফলানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারলে পুরো করোনাবিরোধী অভিযান অর্থহীন হয়ে পড়বে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের আশঙ্কার বিষয়টি সরকারও স্বীকার করে নিয়েছেন এবং ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর ১১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সমগ্র বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছেন। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্ত। তাই এ-ধরনের মহামারী সংক্রমণ লুকানো আত্মহননের সামিল।
বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার পথে বেশ কিছু শক্তি বাধা রয়েছে। সেগুলো উপলব্ধি করে অপসারণের ব্যবস্থা না করলে ইপ্সিত ফলাফল মিলবে না। বাঙালিরা অনেক বেশি সামাজিক, আড্ডাপ্রিয় এবং বহির্মুখী। চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলা একটি অতি প্রিয় বাঙালি স্বভাব। তাই করোনা সংক্রমণ পরিহারের জন্য সঙ্গ নিরোধ ব্যবস্থা, আত্ম-অন্তরণ কিংবা ঘৃহ-অন্তরণ ব্যবস্থা খুব একটা কাজ করছে না। কিন্তু এটিকে কাজ করাতেই হবে। সামাজিক মেলামেশা করোনা সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম। এ ব্যাপারে চার্চ এবং ক্যাসিনো উভয়ই ঐক্যমত্য পোষণ করছে এবং বিশ্বব্যাপী তা গৃহীতও হয়েছে। আর পরস্পর-বিরোধী এই দুই প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাপারে যখন একই মত পোষণ করে তখন বুঝতে হবে যে ব্যাপারটি সত্যিই গুরুতর। প্রার্থনালয়ে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, ক্যাসিনো বন্ধ করা হয়েছে, তারপরও যদি মানুষ যুথবদ্ধ হতে চায় তাহলে কঠোর আইন প্রয়োগের বিকল্প কি?
করোনা নিয়ন্ত্রণে আরেকটি বড় সঙ্কট মনে হচ্ছে করোনাক্রান্তদের সেবাদানকারী চিকিৎসক/নার্সদের প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষা সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা। খোদ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IEDCR)-এর অনেক স্টাফ আক্রান্ত হয়েছেন। সিলেটের ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার মইন উদ্দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এছাড়াও আরোও অনেক ডাক্তার, স্বাস্থ্য সেবাকর্মী, নার্স, করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেক ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। ডাক্তারদের করোনা আক্রান্তের হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বলে জানাচ্ছেন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ)। কার্যকর PPE (পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট)-এর অপর্যাপ্ততা এর অন্যতম কারণ বলে ধরে নেয়া যায়। স্বয়ং চিকিৎসক ও নার্স যদি সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর ব্যবস্থা না পান তাহলে তারা করোনা আক্রান্তদের সেবা কীভাবে দেবেন?
তবে বাংলাদেশের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হলো প্রধানমন্ত্রী নিজেই অহর্নিশ করোনা পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। ঢাকায় বসে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন, দলীয় নেতাকর্মী সবার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে সর্বশেষ তথ্যাদি সংগ্রহ করছেন। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে সরাসরি প্রয়োজনীয় ডিরেক্টিভস দিচ্ছেন। মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। অযথা ভীত বা আতঙ্কিত না হয়ে সাহস-সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। নিহত ডাক্তারের পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন-আবার দায়িত্ব-বিমুখ পলায়নপর চিকিৎসকদের সতর্ক করতেও ভুলছেন না। তবে সবচাইতে বেশি চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো, এই বৈরী করোনাকালে স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া দিন মজুর কিংবা দুঃস্থ অসহায় মানুষদের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর দুঃচিন্তা। ঘরে ঘরে ত্রাণ পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন আবার ত্রাণ তছরূপকারীদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। স্বল্পমূল্যে চাল পাওয়া রেশন কার্ডের আওতাভুক্ত মানুষের সংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে দ্বিগুণ করছেন।
তবে করোনা সঙ্কটের কারণে বিশ্বের যে অনিবার্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে ধরে নেয়া যায়। বিশ্বব্যাপী লকডাউন ব্যবস্থার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম থেমে যাবে এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরে বিরাট হুমকি আসবে। বিশ্ব বাণিজ্য পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়বে। জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন এজেন্সির হিসাব মতে, করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ২ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার লোকসানের শিকার হবে এবং করোনা কবলিত প্রায় সকল দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার কবলে পতিত হবে। ১৯৩০-এর মহা অর্থনৈতিক মন্দা (Great Depression)-এর পর ২০০৭-২০০৮ সালে মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল চাহিদার পতন। কিন্তু করোনা-জনিত কারণে সৃষ্ট মন্দা ঘটবে চাহিদা এবং যোগান উভয়ের যুগপৎ পতনের কারণে, যা হবে অনেক বেশি বিধ্বংসী। লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি হারাবে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ, সেখানে লকডাউন দশা দীর্ঘায়িত হলে এবং তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন থমকে গিয়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই অস্থিরতার প্রভাব পড়বে চাকরির বাজারে। আইএলও-এর হিসাব মতো করোনা পরিস্থিতির কারণে আগামী তিন মাসে বিশে^ সাড়ে উনিশ কোটি মানুষ চাকরিচ্যুত হবে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশেগুলো সাড়ে বারো কোটি এবং এর অভিঘাত বাংলাদেশেও পড়বে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর একজন চাকরি হারানো মানে একটি পরিবার বিপদাপন্ন হওয়া। ইতোমধ্যে খোদ মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সেখানেও চাকরিচ্যুতি শুরু হয়েছে। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের চাকরিচ্যুতির আশঙ্কা রয়েছে এবং তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। এই পরিস্থিতি হবে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো।
সবদিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতির সাময়িক এবং স্থায়ী উত্তোরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। লকডাউনের কারণে কাজ হারানো দিন মজুর, রিক্সা চালক, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক প্রভৃতি পেশার মানুষদের জন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে সমাজের বিত্তবান মানুষেরা এগিয়ে আসছে ত্রাণ কার্যে, যা হয়তো তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। করোনা পরিস্থিতির আর্থিক অভিঘাত থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ৭২,৭৫০ কোটি টাকার, যা দেশের জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বিদ্যামান অবস্থার উত্তরণে কেবলমাত্র সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
আতঙ্কিত হয়ে কিংবা আতঙ্ক সৃষ্টি করে করোনার হাত থেকে নিস্তার মিলবে না। সচেনতা, সাবধানতা এবং বিচক্ষণতার মধ্য দিয়েই করোনা সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হবে। প্রচন্ড জীবনবোধ এবং প্রবল আশাবাদই পারবে করোনার অন্ধকার মেঘের কিনারে রূপালী রেখার ঝিলিক দেখাতে। রাত যতো গভীর ভোর ততোই আসন্ন।
শেষ কবে অলস দুপুরে একটু ভাতঘুম দিয়েছিলাম, কিংবা বিছানায় শুয়ে মাসুদ রানা পড়েছিলাম, কিংবা বাবা-মা-ভাই-বোনদের নিয়ে সস্তা আড্ডায় মেতেছিলাম। করোনা আমাদের অন্তত দম ফেলার ফুরসতটুকু দিয়েছে। লকডাউনে বসেও প্রিয়জনদের ভার্চুয়াল সান্নিধ্যের উষ্ণতা অনুভব করা যাচ্ছে। ভেবে ভালো লাগছে, বিশ্বের পরম পরাক্রমশালী দেশগুলো কিরকম ন্যাজ গুটিয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে বিশ্বকে চোখের পলকে ধ্বংস করার সামরিক শক্তি যখন করায়ত্ত, তখন এক সুন্দর সকালে অবাক বিস্ময়ে দেখল সামান্য এক জীবাণুর কাছে মানুষ কতো অসহায়। কতো সীমিতই না তাদের শক্তি প্রকৃতির কাছে।
এই উপলব্ধি আজ বড্ড প্রয়োজন। যান্ত্রিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষের জন্য মানুষ প্রকৃতির ওপর বলাৎকার করেছে, সবুজ শ্যামল প্রকৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, আর তাই বিশ্ব এখন উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। উষ্ণায়নের কারণে তুন্দ্রা, সাইবেরিয়া কিংবা আলাস্কা অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে পুঞ্জিভূত এই বরফ স্তূপের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে করোনার মতো আরো কতশত অণুজীব তার হিসাব কে রাখে। সেসবের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বিশ্বকে শান্ত রাখা, নিজেকে শান্ত রাখা। একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যে ব্যয় হয় তা দিয়ে কোটি কোটি গাছ লাগানো যেতে পারে। বনায়ন করা যেতে পারে। তাই সময় এসেছে মানবজাতিকে এক সাথে কাজ করতে হবে, সাসটেইনেবল ডেভলেপমেন্ট গোল-১৭-তে যে পার্টনারশিপের কথা বলা হয়েছে তার মাহাত্ম্য অনুধাবন করে, করোনা প্রতিকারের উপায় খোঁজার পাশাপাশি করোনার কারণ খুঁজে তার মূলৎপাটন করা। পৃথিবীকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ রাখা। পৃথিবী নামক এই মাদার প্লানেটে হোমো সেপিয়ানসের টিকে থাকার প্রথম যোগ্যতা হলো- প্রকৃতিকে মিত্রজ্ঞান করা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশকে বাধাগ্রস্থ করতে চাইলে, প্রকৃতি তো প্রতিশোধ নেবেই। মাবনজাতির অস্তিত্ব নিয়ে ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ম্যালথুসের সতর্কবার্তা ফলছে কিনা কে জানে?
লেখক: উপচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন