১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ১০ ইঞ্চি সাইজের ইলিশ, যা জাটকা নামে পরিচিত, ধরা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এ সময়ের মধ্যে জাটকা ধরা, বিক্রি, মজুদ ও পরিবহন করলে সার্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ সময়ে জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে বেকার হয়ে পড়ে বলে। তাদের সহায়তার জন্য সরকার প্রতি জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়া ভিজেএফ চাল বরাদ্দ বলবৎ রয়েছে। তারপরও নিষিদ্ধ এই সময়ে জাটকা নিধন বন্ধ নেই। এক শ্রেণীর জেলে জাল নিয়ে নেমে পড়েছে। শত শত টন জাটকা ধরে বাজারে বিক্রি করছে। জাটকার পরিচয় লুকাতে এগুলোকে চাপিলা মাছ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে জাটকা নিধন যদি এখনই বন্ধ করা না যায়, তাহলে আগামী মৌসুমে ইলিশের ব্যাপক উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৬ মে থেকে দেশের নদ-নদীতে অবৈধভাবে জাটকা নিধনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। এতদিন করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় এবং এর মোকাবেলায় প্রশাসন ব্যস্ত থাকায় এদিকে ঠিকমতো নজর দেয়া যায়নি। এ সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু জেলে জাটকা নিধন শুরু করে।
এ পর্যন্ত যে শত শত টন জাটকা নিধন করা হয়েছে তা যদি ধরা না হতো, তাহলে এগুলো বড় হতো ও মানুষের পর্যাপ্ত চাহিদাপূরণ করতে পারত। উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। অপরিণত এসব জাটকা ধরে বিক্রি করায় একদিকে যেমন ইলিশ উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে, তেমনি ক্রেতাদের সাথে চাপিলা মাছ নামে বিক্রি করে প্রতারণাও করা হয়েছে। এতে জাটকা নিধনকারীরা সাময়িকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে জাটকা নিধন বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করায় দেশে ব্যাপক ইলিশ উৎপাদিত হয়। সোনার হরিণ হয়ে ওঠা ইলিশ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসে। মানুষের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থেকে যায়। উদ্বৃত্ত ইলিশ বিদেশে রফতানিও করা হয়। এর মধ্যে ব্যাপক পরিমাণ ইলিশ বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজেও সংরক্ষণ করা হয়। ফলে সারাবছরই ইলিশ বাজারে পাওয়া যায়। ইলিশ এখন আর এক সিজনের মাছ নয়, তা সব সিজনের মাছে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, এর উৎপাদন বৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাটকা নিধন বন্ধ রাখা। আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে প্রায় ২৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়, যা মোট চাহিদার চেয়েও বেশি। বিশেষজ্ঞরা চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে ইলিশের রফতানির বাজার সৃষ্টি করার তাকিদ দিয়ে আসছেন। মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গে রফতানি হয়। বিশ্ববাজারে সুস্বাদু এই মাছের বাজার সৃষ্টি করতে পারলে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে এবং এটি আলাদা একটি রফতানি খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। এ বছর ইলিশসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ বা তারও বেশি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এই আশাবাদের কারণ, উপযুক্ত পরিবেশ। করোনার কারণে কলকারখানা বন্ধ থাকায় নদীদূষণও কমে গেছে। কলকারখানা থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত কেমিক্যালই পানি দূষণের প্রধান কারণ। এর ফলে নদ-নদীতে মাছের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার যে ইকোলজিক্যাল পরিবেশ প্রয়োজন, তা বিনষ্ট হয়ে যায়। এখন নদীদূষণ কমে যাওয়ায় মাছের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত নদীতে এখন স্বচ্ছ পানির ধারা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য নদ-নদীর দূষণও কমে টলমল ধারার সৃষ্টি করেছে। যে দূষণের কারণে দেশের একমাত্র মিষ্টিপানির প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় মাছের ডিম ছাড়া আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছিল, দূষণ কমায় এবার তাতে ডিম আহরণের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। নদ-নদীর এই স্বাভাবিক পরিবেশের কারণে ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর মৎস্য উৎপাদন রেকর্ড ছাড়াবে। তবে এই আশায় বাঁধ সেধেছে একশ্রেণীর জেলে, যারা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে জাটকা নিধন করে চলেছে।
সামনের দুর্দিন সামলাতে মৎস্য চাহিদা পূরণে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে রাখার বিকল্প নেই। যেহেতু আশা করা হচ্ছে, প্রকৃত অনুকূলে থাকায় এবার ইলিশ উৎপাদনেও নতুন রেকর্ড হবে, তাই যারা জাটকা নিধন করছে তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। এজন্য জাটকা পাহারার কাজটি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নদ-নদীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত টহল শুরু করতে হবে। সাময়িক লাভের জন্য শত শত টন জাটকা নিধন হবে এবং ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত করা হবে, তা হতে পারে না। এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। রাজধানীর বাজারগুলোতেও জাটকা বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। যারাই জাটকার সাথে জড়িত থাকবে তাদের গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে, তাদের খাদ্যসহায়তা যথাযথভাবে দেয়া হচ্ছে কিনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন