সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফারাহ খান বলেছেন, লকডাউনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত সিরাজুল আলম খানের বাবা-মায়ের কবরের প্রতি অসম্মান করেছে সড়ক বিভাগ। তিনি জানান, স্বাধীন বাংলাদেশের রুপকার, নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর শীর্ষ নেতা সিরাজুল আলম খান (দাদা) আমার মেঝ-চাচা।
তিনি বলেন, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নোয়াখালীতে আসেন এবং আমার দাদা খোরশেদ আলম খানের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক ‘সাহেব বাড়ি’র আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এই বাড়ির উত্তর পার্শ্ববর্তী মাঠে তিনি জনসভায় বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানের মাতা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনকে সব সময়ের মত তখনও ‘মা’ বলেই সম্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তখন আব্দুল মালেক উকিল (পরবর্তীতে স্পিকার), শহীদউদ্দিন ইস্কান্দার (কচি মিয়া), নুরুল হক মিয়া (তৎকালীন শ্রমিক লীগের সভাপতি), মরহুম আব্দুল রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ সহ আরো অনেক ছাত্রনেতা ঐ বাড়িতে গিয়েছিলেন, যারা আজ সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ে আছেন।
শুধু তাই নয়, এই ‘সাহেব বাড়ি’ থেকে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধারা বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় অবস্থিত টেকনিকাল হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করা পাক বাহিনীর সাথে সরাসরি গুলি বিনিময়ের মাধ্যমে যুদ্ধ করে ঐ এলাকা থেকে পাক বাহিনীকে কুমিল্লা ফিরে যেতে বাধ্য করে। এবং তারই রেশ ধরে ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমাদের এলাকা স্বাধীন হওয়ার দুই/একদিন পর মুজিব বাহিনীর নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের দায়িত্বে থাকা শেখ ফজলুল হক মনি আসেন সিরাজুল আলম খানের ‘সাহেব বাড়ি’ তে।
তিনি উল্লেখ করেন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আলীপুরে ১৯৪০ সালে আমার দাদা খোরশেদ আলম খান সদরের কালীতারা হতে এসে বাড়িটি নির্মান করেন। সিরাজুল আলম খানের জন্ম এ বাড়িতেই। তিনি সহ তাঁর নয় ভাই-বোনের সকলে বেড়ে উঠে এই ‘সাহেব বাড়ি’তে। এলাকার মানুষ ‘সাহেবের বাড়ি’ ডাকার সুবাদে সেই বহুকাল আগে থেকেই ‘সাহেব বাড়ি’ নামকরণ হয়েছে আমাদের বাড়িটির। এর কারণ, হচ্ছে আমার দাদা, খোরশেদ আলম খান (সিরাজুল আলম খানের বাবা) তিনি ব্রিটিশ আমলে এই এলাকার একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ব্রিটিশ স্কলারশিপ (বৃত্তি) নিয়ে ১৯৩৭ সনে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ থেকে শিশু মনোবিজ্ঞান (child psycology) এর উপর উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি একজন সরকারি চাকুরিজীবি ছিলেন এবং সে সময় স্কুল পরিদর্শক (inspector of school) হিসেবে কাজ করতেন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে পাবলিক ইন্সট্রাকশনের উপ-পরিচালক (ডিডিপিআই) (the Deputy Director of Public Instruction- DDPI) হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। আমার দাদু সৈয়দা জাকিয়া খাতুন পীর বাড়ির সন্তান এবং তিনিও সেই সময়ে এলাকার একজন শিক্ষিত, মার্জিত ও সম্মানিত নারী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর বাবা ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
শত ইতিহাসের সাক্ষী ও ভালবাসার স্মৃতি তে অমলিন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত সেই ঐতিহ্যবাহী ‘সাহেব বাড়ি’ কে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে চলছে নানা রকমের খামখেয়ালিপনা। সড়ক বিভাগ থেকে বলেছে, চৌরাস্তা থেকে মাইজদী পর্যন্ত কুমিল্লা-নোয়াখালী চার লেন সম্প্রসারণের জন্য আমাদের ১৭.১ শতাংশ জায়গা অধিগ্রহণ করবে। কোন দিনক্ষন নির্দিষ্ট না করে, কোন প্রকার নোটিশ না দিয়ে হঠাৎ করে যখন পুরো দেশের সব কিছু বন্ধ, এই করোনার লকডাউনের মধ্যে সোমবার ৪ মে ২০২০ বুলডোজার দিয়ে সিরাজুল আলম খানের পৈতৃক ভিটা ‘সাহেব বাড়ি’র সীমানার দেওয়াল, প্রাচীর ও মূল গেইট ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
এতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি। সিরাজুল আলম খানের পারিবারিক কবরস্থান যেখানে তাঁর পিতা এবং মাতা- যাকে বঙ্গবন্ধুও ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন, বড় ভাই ও ভাবির কবর রয়েছে, সেটিও তারা কোথাও স্থানান্তর না করে কিংবা আমাদের পরিবারকে স্থানান্তরের জন্য পূর্ব বার্তা বা সময় না দিয়ে, ভেঙ্গে ফেলা শুরু করে। লকডাউনের মাঝে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় সিরাজুল আলম খানের এক ভাই পিতা-মাতার পারিবারিক কবরস্থানটি পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলতে বাঁধা দিয়েও নিরুপায়। যদিও পারিবারিক কবরস্থানটি রাস্তা থেকে বেশ দূরেই অবস্থিত। কুমিল্লা-নোয়াখালী রাস্তার সম্প্রসারণ কাজের কারণে কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করা হলেও আমাদের পারিবারিক কবরস্থানটির তখনো কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে রাস্তার জন্য আরও কিছু জায়গার প্রয়োজন দেখা দিলে সিরাজুল আলম খানের পৈতৃক ভিটা, জায়গা ও কবরস্থান থেকে আরও ১৭.১ শতাংশ জায়গা পুনঃ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, আমাদের থেকে ১৭.১ শতাংশ (৪০০ফিটের কিছু বেশি) জায়গা নেওয়া হলেও আমাদেরকে সঠিক ও ন্যায্য ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়নি। আপত্তি ও অনুরোধ করে সরকার বা সড়ক বিভাগের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া কিংবা কোন সুরাহা করা যায়নি, যা বেআইনী ও বেদনাদায়ক। কারণ, সরকার বা সড়ক বিভাগ আমাদের পারিবারিক কবরস্থানটি স্থানান্তর করে দেয়নি, যা আইন অনুযায়ি তাদেরই করার কথা। অন্যথায়, আমাদেরকেও পর্যাপ্ত সময় অথবা নোটিশ প্রদান করেনি কাজটি করার জন্য। ক্ষতিপূরনের কোন অর্থ এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা না হলেও ১৭.১ শতাংশ জায়গা (৪০০ফিটের বেশি) দিয়ে হলেও দেশ ও জনগণের সেবা করতে পারাটা আমরা গর্বের মনে করি। তবে তা অবশ্যই ন্যায় ও সঠিকভাবে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য, দলীয়করণ, বিশেষ মহলের ইন্ধন ও আক্রোশে প্রভাবিত না হয়ে।
তাহলে অন্তত স্বাধীন বাংলাদেশের রুপকার, নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক, মুজিব বাহিনীর শীর্ষ নেতা, বাংলাদেশের দার্শনিক নেতা সিরাজুল আলম খান দাদার পিতা-মাতার কবরের প্রতি সম্মান দেখানো যেতো এবং সেগুলো রক্ষা করা যেতো। সরকার ও সড়ক বিভাগ না পারলেও, আমরা অন্তত পারিবারিক ভাবে নিজ খরচে হলেও কবরস্থান স্থানান্তরের কাজটি সুন্দর ও সুপরিকল্পিত ভাবে করতে পারতাম। তাহলে কেনো এই অসম্মান?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন