শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নিখোঁজ বা সন্দেহ তালিকায় শুভঙ্করের ফাঁক

প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত তরুণদের অনেকেই পারিবারিকভাবে নিখোঁজ, কিছু কিছু পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ সন্তানদের সন্ধানে থানায় জিডিও করা হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিখোঁজ তরুণ-তরুণীদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে র‌্যাব কর্তৃক ২৬২ জনের তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই তালিকা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠতে থাকে। তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম দফায় ১১ জন এবং বৃহস্পতিবার আরও ৪৯ জনের খোঁজ মিলেছে বলে গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়। পিতা-মাতার সাথে অভিমান করে অথবা প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়া তরুণ-তরুণীদের নাম নিখোঁজ তালিকায় উঠে আসার পর কেউ কেউ স্বেচ্ছায় থানায় এবং পরিবারে হাজির হয়ে নিজেদের ফিরে আসার তথ্য জানান দিয়েছেন। র‌্যাবের ২৬২ জনের তালিকার মধ্যে জেলাওয়ারি ও ক্রমিক অনুসারে এসব নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামধাম ও অবস্থানের চিত্র তুলে ধরে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়, কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই এই তালিকা প্রকাশ করেছে র‌্যাব। এ ধরনের তালিকা প্রকাশের পর নিখোঁজদের ফিরে আসা বা জঙ্গি সম্পৃক্ত নন এমন ব্যক্তিদের নামও তালিকায় ঢুকেপড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে যখন দেখা যাবে, তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যক্তিই নিখোঁজ বা জঙ্গি সম্পৃক্ত নন, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকা- নিয়েই জনমনে প্রশ্ন উঠবে।
গতকাল একটি দৈনিকে র‌্যাবের তালিকাভুক্ত নিখোঁজ থেকে খোঁজ পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলার ২৯ জনের মধ্যে ২৪ জনই ঘরে আছেন বা ফিরে এসেছেন, বাকিদের কেউই জঙ্গি সম্পৃক্ত নন বলে জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। অথচ র‌্যাব-পুলিশ এই তালিকা ধরেই নানা স্থানে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি শুধু যে একটি পরিবারকে ভয়াবহ আতঙ্ক ও পুলিশি বিড়ম্বনায় ফেলে তা’ নয়, পাশাপাশি সেই পরিবারের আশপাশের পুরো এলাকায়ই এক ধরনের আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী হয়। ভুল বা যাচাই বাছাই ছাড়াই নিখোঁজ সন্দেহভাজনদের তালিকা প্রকাশ করায় অযথা অনেক পরিবার বিড়ম্বনা ও পারিবারিক মর্যাদাবোধে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। র‌্যাবের নিখোঁজ তালিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক এই তালিকা ধরে খোঁজ-খবর নিয়ে পুলিশ একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরী করবে বলে জানিয়েছেন। তাহলে র‌্যাবের এই তালিকা কিসের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছিল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কোন নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াই এই তালিকা তৈরী হয়েছিল। এই যদি হয় দেশের এলিটফোর্সের জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মকা-ের নমুনা তাহলে মানুষ আস্থা রাখবে কোথায়?
জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীদের প্রাথমিক প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে দেশে আতঙ্ক ছড়ানো। এর ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যাহত হয়, দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবাদ বিরোধী তৎপরতায় দেশে আরো বেশী ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে গুলশান-বনানীর রেস্তোরাঁসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ধস নেমেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে আস্থার পরিবেশ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা। প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য এবং পূর্বাপর বিবেচনা ছাড়াই অভিযান পরিচালনা করা, নিখোঁজ ও সন্দেহভাজনদের তালিকা প্রকাশের কারণে হয়তো প্রকৃত অপরাধীরা অধরাই থেকে যাচ্ছে। এ কথা ঠিক যে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমাদের পুলিশ বাহিনীর যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। তবে টার্গেট কিলিং, গুম বা জঙ্গিবাদ দমনে গতানুগতিক ফর্মুলা তেমন কোন কাজে আসছেনা। এমনকি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোও এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের একটি অভিন্ন বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকলেও পশ্চিমাবিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। দেশীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বিবেচনাসমূহ মাথায় রেখেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কর্মসংস্থান ও শিক্ষার জন্য বিশ্বের সব প্রান্তেই আমাদের নাগরিকরা ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকায় এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল সমুদ্রপথেও আমাদের তরুণরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ার মত যুদ্ধকবলিত দেশগুলো থেকে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়ে ইউরোপীয় রিফিউজি ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে। সেখানে শত শত বাংলাদেশী তরুণকেও দেখা যাচ্ছে। গত বছর মেসিডোনিয়া সীমান্তে বাংলাদেশী তরুণরা ‘আমাদের গুলি কর, তবু আমরা বাংলাদেশে ফিরে যাবো না’ লেখা প্লাকার্ড ঝুলিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল। এসব বেপরোয়া তরুণের কেউ কেউ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের নেপথ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ ও জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়েই তার সমাধান সম্ভব। ভুল তথ্য বা গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে গৃহীত ভুল সিদ্ধান্ত বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে না পারলেও অহেতুক আতঙ্ক ও জনভীতি সৃষ্টি করে, এমন যে কোন উদ্যোগ সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন