আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : সারাদেশে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চলছে মৎস্য সপ্তাহ। মৎস্য চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে দেশবাসীকে। আশার কথা হল- দেশে বর্তমানে মৎস্য উৎপাদন চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত। মৎস্য রফতানি করে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। আর রফতানির বিরাট অংশ যায় খুলনাঞ্চল থেকেই। খুলনাঞ্চলের চিংড়ি রফতানি জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তর খুলনার প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মৎস্য চাহিদার তুলনায় উৎপাদন উদ্বৃত্ত। তবে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে রফতানি।
মৎস্য অধিদপ্তর খুলনার সূত্রমতে, খুলনা বিভাগের ৭৫ হাজার ৭১৬টি (গলদা+বাগদা) ঘেরে গত বছর ২৭ হাজার ৩৪৫ দশমিক শূন্য ৭ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়। যা ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে রফতানি করে ২ হাজার ৫১৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। যা ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে অর্জিত হয়েছে ২ হাজার ১৪৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কমেছে ৩৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের এ তিন জেলার ২৫ উপজেলায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে গলদার চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলে এক লাখ নর-নারীর দু’হাতের পরিচর্যায় বছরে ২২ হাজার মেট্রিক টন গলদা উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত চিংড়ির বাজার মূল্য ২ হাজার ১২ কোটি টাকা।
সাতক্ষীরা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল ওদুদ জানান, তালা ও জেলা সদরে গলদা চাষের চাহিদা বেড়েছে। এখানে বেশীর ভাগ জমিতে বোরো ধান কাটা শেষে গলদা চাষ হয়।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল জানান, গেল বছর ৮১৪ কোটি টাকা মূল্যের গলদা উৎপাদন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফকিরহাট, মোল্লাহাট ও চিতলমারী উপজেলায় গলদার উৎপাদন সন্তোষজনক।
সালাম সী ফুডের ম্যানেজার মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, এ অঞ্চলের উৎপাদিত গলদা জাপান-জার্মান, ইংল্যান্ড ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইউএসএ কানাডায় চাহিদা বেশী। বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশের বেশী সরবরাহ করা হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশে দামের তারতম্য রয়েছে। তারপরও গড়ে প্রতি কেজি মাথাসহ ৮ ডলার এবং মাথা বাদে ১২ ডলার মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কারণে চিংড়ি রফতানি কমছে।
সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি রফতানি কমার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে- অপদ্রব্য পুশ, প্যাকেজিং বন্ড, ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং কাস্টমস্’র আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই মূল প্রতিবন্ধকতা।
তবুও খুলনাঞ্চলে পুশ বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকলেও থেমে নেই চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতায় মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর এ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গেল বছরের তুলনায় এ বছর জুলাই মাস পর্যন্ত ৩৪টি অভিযান বেশি পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু অভিযান অব্যাহত থাকলেও অধিক লাভের আশায় সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ করছে অধিকাংশ ব্যবসায়ী। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও যশোর অঞ্চলে ৪৩টি মাছ কোম্পানি ও ছোট-বড় এক হাজারের অধিক ডিপো রয়েছে। এরমধ্যে মাছ কোম্পানি চলমান রয়েছে ২৮টি।
সূত্র জানায়, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, পূর্ব রূপসা, ফুলতলার জামিরা বাজার, শাহাপুর, আড়ংঘাটা, চুকনগর, ডুমুরিয়া, ফয়লা বাজার, ফকিরহাট, ফলতিতা বাজার, পাইকগাছা, খর্ণিয়া বাজার ও মংলাসহ বিভিন্ন এলাকার মৎস্য ডিপোতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি এসব অঞ্চলে র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তরের যৌথ অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত খুলনাঞ্চলের বিভিন্ন মৎস্য ডিপো ও পরিবহনে ১৮৯টি পুশ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। গত বছর অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল ১৫৫টি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনাঞ্চলের একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, পুশ বিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ায় পুশ করা চিংড়ি চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকার কোম্পানিতে পিকআপ ও ট্রাকে করে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের পুশ বিরোধী অভিযান বা তদারকি জোরদার না থাকায় চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ করছে ব্যবসায়ীরা। অনেক এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেও চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের অভিযোগ আছে। এ সেক্টরকে টিকিয়ে রাখতে ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল পুশ বিরোধী অভিযান আরো জোরদারের দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ খুলনা’র উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার জানান, চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশের মাত্রা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে। র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতায় পুশ বিরোধী অভিযান চালানো হয়। পুশ নির্মূলে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) সভাপতি এসএম আমজাদ হোসেন চিংড়ির রফতানি বৃদ্ধিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সুপারিশসমূহ তুলে ধরে বলেন, চিংড়ি রফতানিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক ঘাটতি নিরসনকল্পে ব্যাংক প্রদত্ত চলতি মূলধন ঋণের ৫০ শতাংশ সুদমুক্ত ব্লক একাউন্টে রেখে সমপরিমাণ ঋণ প্রদান করাতে হবে। প্রকৃত চিংড়ি চাষীদেরকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে হবে। এছাড়া রাশিয়া হিমায়িত চিংড়ি রফতানির একটি বৃহত্তম বাজার। বর্তমানে পাঁচটি কারখানা রাশিয়ায় চিংড়ি রফতানি করে। তাই দেশটিতে অধিক কারখানার তালিকা প্রেরণের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সোর্স ট্যাক্স ও নগদ সহায়তায় অগ্রিম আয়কর কর্তন বন্ধ করতে হবে। তাহলেই হিমায়িত চিংড়ি খাত হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় খাত।
বিএফএফইএ’র পরিচালক তরিকুল ইসলাম জহির বললেন, কোন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান পুশ করে না। আমরাও পুশ বিরোধী। প্যাকেজিং সামগ্রী সরবরাহ, ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং কাস্টমস্’র আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে পারলেই চিংড়ি খাত থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন