শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ

মাহমুদ ইউসুফ | প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

পদ্মা শুধু একটি নদীর নাম নয়, এটা জীবনেরই অপর নাম। বাংলাদেশের অস্তিত্বের অনুসঙ্গী পদ্মা। ১৭ কোটি বাংলাদেশির হৃদয়ের স্পন্দন পদ্মা। আমাদের জান-প্রাণ পদ্মার সাথে মিশে একাকার। পদ্মা ছাড়া বাংলাদেশিদের জীবন তাৎপর্যহীন। ঐতিহাসিক গঙ্গারিড়ি সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল এই পদ্মা পাড়েই। চাষি, মজুর, জেলে, নাপিত, কামার, কুমোর সবার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট পদ্মা নদী। তাই পদ্মাকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের প্রথম ও প্রধান সংগ্রাম। আমাদের একমাত্র শ্লোগান: ফারাক্কা নিপাত যাক, পদ্মা প্রাণ ফিরে পাক। ‘মরণফাঁদ ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও’ একদা এই শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চ। 

বিশ^সভ্যতার ইতিহাসে মানবসৃষ্ট বৃহত্তম পিবর্যয়ের উৎস ফারাক্কা বাঁধ। পৃথিবীর ইতিহাস বা মানুষের ইতিহাসে এরকম কৃত্রিম বিপদের দ্বিতীয় নজির নেই। প্রথম-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইউরোপের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধও ফারাক্কা-তিস্তা ব্যারেজের ক্ষয়ক্ষতির কাছে তুচ্ছ। হিরোশিমা-নাগাসাকি বাদে এসব যুদ্ধবিগ্রহে প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি নয়। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানবিক বিপর্যয়, পরিবেশ বিপর্যয়, কৃষি-শিল্প-পানি-বনজ-মৎস্য সম্পদে বিপর্যয়সহ সব ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ঘটেছে ফারাক্কা বাঁধের পাশর্^ প্রতিক্রিয়ায়। বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, ‘১৪ লাখ বছর ধরে যে জলজ ও প্রাকৃতিক জীবন গড়ে উঠেছে এই ভারতবর্ষে, তা ধ্বংস করার কোনো অধিকার আপনার নেই। ফারাক্কা বাঁধ সমগ্র নদী-নালা, বন, প্রকৃতি, প্রাণী, কীট, ব্যাকটেরিয়াকে বিনাশ করে নারকীয় হাহাকারে ভরে তুলবে উপমহাদেশকে।’ ভারতের খ্যাতনামা প্রকৌশলী শ্রী কপিল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ফারাক্কা বাঁধ গোটা গঙ্গা অববাহিকার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ব্যবস্থা নষ্ট করে দিবে।’ ‘ফারাক্কা বাঁধের অপকারিতা’ শীর্ষক পুস্তিকা লেখার কথিত অপরাধে তিনি চাকরিচ্যুত হন। শ্রী কুলদীপ নায়ার বলেন, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত মারত্মক ভুল করেছে। বড় বাঁধগুলো গঙ্গানদীর ভাটিতে স্বাভাবিক প্রবাহ, জীবজন্তু ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি করেছে।’
বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লং মার্চের আয়োজন করেন। উত্তরবঙ্গের লাখো জনতা তার আহবানে সাড়া দিয়ে লং মার্চকে সফল করেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহী মাদরাসা ময়দান থেকে লং মার্চ শুরু। শেষ হয় পরের দিন চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ব্যারাজ চালু করে শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী সরকার। মাত্র ৪১ দিনের পরীক্ষামূলক পানি প্রত্যাহারের সময়সীমা এখনো এত বছরেও শেষ হয়নি। এই হলো ইন্ধিরা গান্ধীর চাণক্যনীতি। ১৯৭৫ সালের বর্ষা মওসুম পার হবার সাথে সাথেই ফারাক্কার অশুভ প্রতিক্রিয়া শুরু হয় রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে। আজ তো সারা দেশই বিপর্যস্ত। ১৯৭৬ সালেই ফারাক্কা সমস্যা জাতীয় প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। দেশের বিভিন্ন সংগঠন ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, সুপ্রিম কোট বার এসোসিয়েশন ও তার প্রতিটি জেলা কমিটি পানি প্রত্যাহারে গভীর উদ্বেগ প্রচার করে। দেশের রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভারত কর্তৃক আন্তর্জাতিক পানি ও নদীনীতি লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন করে। আর ৩৯ বছর পর ভারতীয় লুটপাটের প্রতিবাদ করায় আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে তার ছাত্রবন্ধুরা। ১৯৭৬ আর ২০১৯। দেশপ্রেমে আমরা ‘চ্যাম্পিয়ানশিপ’ অর্জন করেছি।
ফারাক্কা কেড়ে নিয়েছে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য। বাংলাদেশ হারিয়েছে সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা ও নাতিশীতোষ্ণ বৈশিষ্ট্য। গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে কৃষি, শিল্প, মৎস্য, নৌপরিবহন, পরিবেশ প্রকৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অশুভ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরার জন্য সভা সেমিনারের আয়োজন করা হয়। লং মার্চ আয়োজনের পূর্বে ভাসানী বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে বিশ্বের ইতিহাসে এক অমানবিক আচরণের নজির সৃষ্টি করেছে।’ ভারত ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার বন্ধ না করলে এবং আপোস মীমাংসায় রাজি না হলে ভারতের বিরুদ্ধে অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে।
১৬ মে রাজশাহী মাদরাসা ময়দান থেকে ১০টা ৩০ মিনিটে লং মার্চ যাত্রা শুরু। মসিউর রহমান যাদু মিয়া, কাজী জাফর আহমদ প্রমুখ জাতীয় নেতৃবৃন্দ ছিলেন ভাসানীর সহযাত্রী। সন্ধ্যায় নবাবগঞ্জে পৌঁছে ভাসানী ঘোষণা করেন, ‘ভারত ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে আগ্রহী না হলে তিনি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু করবেন।’ তিনি বলেন, ‘ফারাক্কা বাংলাদেশের জন্য এক অভিশাপ। এর প্রতিক্রিয়ায় এ বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হচ্ছে। তিনি ফারাক্কা প্রতিক্রিয়া স্বচক্ষে দেখার জন্য ইন্ধিরা গান্ধীর প্রতি আহবান জানান। নবাবগঞ্জেই মিছিলের রাত যাপন বিরতি। মিছিলে যোগদানকারী অসংখ্য মানুষকে শহরের স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। রাতের খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয় খিচুড়ি। পরদিন কানসাটে লং মার্চ শেষ হয়। কানসাট হাইস্কুল মাঠে ৯৫ বছর বয়স্ক জননেতা ভাসানী ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যার দাবি মেনে নিয়ে ফারাক্কা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানে ভারত অস্বীকৃতি জানালে তিনি আগামী মাসের মধ্যে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে এ বছরের ১৬ আগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু করবেন।’ ফারাক্কা লং মার্চ করে ভাসানী যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, পরবর্তীকালে অন্যরা সে গতি অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই লং মার্চই ফারাক্কা সমস্যাকে বিশ্ববাসীর দরবারে তুলে ধরার প্রথম ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ।
ভাসানীর লং মার্চের এক যুগ পর ১৯৮৯ সালের ২৫ মে বিএনপি নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ফারাক্কা মিছিলের ডাক দেন। শিবগঞ্জ থেকে কানসাট পর্যন্ত প্রায় ১০ কিমি পথ পায়ে হেঁটে এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। স্থানীয় জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় এই শোভাযাত্রায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিল শেষে কানসাট কলেজ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নীতি লঙ্ঘন করে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করায় খরা মওসুমে দেশের নদনদীগুলো শুকিয়ে যায়। অপরদিকে বর্ষার সময় বন্যার পানিতে দেশ সয়লাব হয়ে যায়। পরিণতিতে উত্তারঞ্চলের মানুষ দিশেহার হয়ে পড়েছে। ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ফলে বড়ভাই সুলভ আচরণে ভারতের ওপর বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হলে ভারতকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে।’
কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকদের নীরবতায় আমরা আশাহত। ফারাক্কার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া নিয়ে হতে পারে কাব্য, মহাকাব্য, নাটক, নৃত্য, সিরিয়াল, ফিল্ম। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের জন্য হরতাল, সভা, সমাবেশ করে থাকে, কিন্তু জাতীয় সঙ্কট মরণফাঁদ ফারাক্কায় তাদের মাথাব্যাথা নেই। দেশে একদা ২৬ হাজার নদনদী ছিলো। ছিলো লক্ষাধিক প্রবাহিত খাল, সংযোগ খাল। ছিলো কতশত পুকুর, দীঘি, জলাশয়, বিল। সেই বাংলাদেশে আজ পানির জন্য হাহাকার। গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। উষ্ণতা বাড়ছে হু হু করে। নদীমাতৃক দেশ নদীহীন মরুভূমির দিকে ধাবিত। কবি ফররুখ আহমদ ফারাক্কা বাঁধকে বলেছেন মৃত্যুর তুর্য-নিনাদ। ভারতীয় লেখক জয়ন্ত জোয়ারদার তাঁর লেখায় ফারাক্কা ব্যারেজের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির ছবি এঁকেছেন। ‘ভুতনি দিয়াবা’ উপন্যাসের নায়ক তার আক্রোশ ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘শালা ফারাক্কাটা যদি উড়িয়ে দিতে পারতাম।’
ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার জন্য ভারতের ভেতরেও জনমত ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে। বিহারের গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রতি বছরের ভয়াবহ বন্যার জন্য ফারাক্কাকেই দায়ী করেন সেখানকার বিশেষজ্ঞরা। এজন্য মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙ্গে ফেলার প্রস্তাব করেন। ভারতের নামী সংরক্ষণ অ্যাক্টিভিস্ট ও নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকর বিবিসি’কে বলছিলেন, ‘একটা বাঁধের প্রভাব যদি খুব ধ্বংসাত্মক হয়, ফারাক্কাতে যেটা হয়েছে, তাহলে সেটা ডিকমিশন করার অসংখ্য নজির কিন্তু দুনিয়াতে আছে। আমেরিকাতেও শতাধিক ড্যাম ভেঙে দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন