সেগুলো কিনে নিয়ে যায়। দেশের গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজারে ‘চায়না’ বলেই বিক্রি হয় এসব। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নকল কারখানাগুলোর দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর অনেক নকল কারবারী সেখান থেকে কারখানাগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু কারখানা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে। আবার সেখানেও নিরিবিলিতে ধরা পড়ার ভয়ে কেউ কেউ যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও মুগদার ব্যস্ত ও ঘিঞ্জি এলাকাকে বেছে নিয়েছে। যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে অনেক আগে থেকেই আছে নকল ফ্যানসহ ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা। রায়েরবাগে আছে নকল খাঁটি গাওয়া ঘি, মধু, দই ও মিষ্টির কারখানা। যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী থানা এলাকাতেই নকল ক্যাবল তৈরির কারখানা আছে কমপক্ষে ৫০টি। দনিয়া ও পাটেরবাগ এলাকায় নকল মশার কয়েল, ঘি, গুড়, হারপিক, খাবার স্যালাইন, ভিটামিন ওষুধ, সুইস, ছকেট, হোল্ডার কারখানা আছে বেশ কয়েকটি। আছে শতাধিক নকল মিনারেল ওয়াটারের কারখানা। মুগদাতে নকল সোয়াবিন তেল থেকে শুরু করে নকল ডিটারজেন্ট পাউডার পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে অবাধে। সূত্র জানায়, নকল কারখানাগুলো থেকে মুগদা থানা পুলিশের নামে মাসোহারা যায় লাখ টাকার বেশি। এ কারণে এসব কারখানা বন্ধ হয় না। পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের অলি-গলিতে তৈরি হচ্ছে নকল টিভি, ফ্রিজ, এনার্জি সেভিং বাল্ব, মোটর, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন মেশিনসহ বিভিন্ন দামি ইলেকট্রিক সামগ্রী।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিউটিশিয়ানরা জানিয়েছেন, নকল প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহারে ত্বকের সমস্যা জটিল হয়, দেহে ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের রোগ। নকলবাজরা এসব তৈরিতে এসিড, পানি, মোম, সুগন্ধি ও পারফিউমের অতিরিক্ত ব্যবহার করে থাকে। মোমের পরিমাণ বেশি হলে তা ত্বকে ঢুকে লোমক‚প বন্ধ করে দেয়। ফলে মেছতা, ব্রন, ফাঙ্গাসজাতীয় রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কারিযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহারে সরাসরি স্কিন ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে। নকল প্রসাধনী তৈরিতে নিম্নমানের ভেজাল সামগ্রী ব্যবহার করায় চুলকানি, ফোস্কা পড়া, ত্বকের প্রদাহ, সংক্রমণ এসব নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জেনেশুনেই অতি লাভের আশায় এসব পণ্য কিনে বিক্রি করেন। শুধু প্রতারিত হন ব্যবহারকারী বা ক্রেতারা। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত হেড অ্যান্ড শোল্ডার, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যান্টিন প্রো-ভি শ্যাম্পু ও ডাভ ক্রিম বা ভারতের গার্নিয়ার শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রিম, লিপস্টিক, লোশন দেদারছে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর চকবাজার ও মৌলভীবাজারে। সেখানকার শতাধিক পাইকারি দোকানে এসব পণ্য মূল দামের অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এগুলো সবই নকল। কিন্তু পণ্যের প্যাকেট বা বোতল ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেও আসল-নকল বোঝার উপায় থাকে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সকল নকল পণ্যের দাম অনেক কম মূল্যে বিক্রি হলেও একটার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নকল বলেই একটি জিনিসের দাম আসলের চেয়ে বেশি। সেটি হলো ওজন মাপার বাটখারা। অধিক মুনাফার লোভে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ওজনে কম দিতে দোকানে ব্যবহার করেন নকল বাটখারা। কাপ্তানবাজার এলাকায় আড়াই কেজি, এক কেজি, পাঁচশ’ গ্রাম, আড়াইশ’ গ্রাম, দুইশ’ গ্রাম, একশ’ গ্রাম ও পঞ্চাশ গ্রামের একসেট আসল বাটখারা কিনতে আটশ’ টাকা লাগে, কিন্তু একসেট নকল বাটখারা কিনতে হয় ১২-১৩শ’ টাকায়।
ভুক্তভোগীদের মতে, বিএসটিআই-এর নির্লিপ্ততাই নকল সামগ্রীর দাপটের জন্য দায়ী। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগটি যুগ যুগ ধরে জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে দায় এড়িয়ে চলছে। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, বিএসটিআই’র অভিযান অব্যাহত থাকলে নকল পণ্যের দাপট কমতে বাধ্য। জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক রেজাউল হক বলেন, একথা ঠিক যে, আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। তাই বলে বিএসটিআই যে বসে আছে তা কিন্তু নয়। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, বিএসটিআই’র অভিযানের কারণেই কিন্তু ভেজাল বলেন আর নকলই বলেন এ ধরনের তৎপরতা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে।
কনজুমার কেয়ার সোসাইটির (সিসিএস) উপদেষ্টা প্রফেসর ডা: আব্দুর রহমান (পিএইচডি) বলেন, নকল পণ্য কিনে আমরা যেমন প্রতারিত হচ্ছি তেমনি ভেজাল খাদ্য খেয়ে আমরা নিজেদের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি। নকলের প্রবণতা আমাদের দেশের তৈরি পণ্যের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে। ভেজালের প্রভাবে আমাদের দেশে কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ বিভিন্ন রোগের প্রভাব আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফরমালিন বা কার্বাইড মেশানো হয় খাদ্যকে সংরক্ষণ করার জন্য। কিন্তু সেটা করছে অশিক্ষিতরা। তারা না বুঝেই পরিমাণ বেশি দিচ্ছে। এটা মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকলে ঝুঁকি এড়ানো যেত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন