বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস

প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাও: এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব

॥ শেষ কিস্তি ॥
৪. কুরআন মাজীদে শব্দটি ওপরে উল্লিখিত পদ্ধতিতে ২০০-এর অধিক লিখিত হয়েছে শুধু একস্থানে এ শব্দটির সাথে “আলিফ” অক্ষর যোগে সূরা ক্বাহাফের ২৩নং আয়াতে এভাবে লিখিত হয়েছে-
যা আরবী লিখন পদ্ধতি অনুযায়ী সঠিক নয়, কিন্তু সমস্ত মাসহাফে (কুরআনে) আজও এভাবেই বিদ্যমান আছে, যেমন নবী (স.)-এর যুগে লিখা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত কোনো প্রকাশক তা সংশোধন করার মত সাহস দেখাতে পারেনি।
৫. সূরা নামলের ২১ নং আয়াতে
শব্দটি এভাবে লিখা হয়েছে যার অর্থ হয়- কিংবা আমি তাকে হত্যা করব। এ শব্দটিতে “জালের” পূর্বে “আলিফ” অক্ষরটি অতিরিক্ত যা শুধু লিখার নিয়ম অনুযায়ীই অশুদ্ধ নয়; বরং অনুবাদ করার ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুলের কারণ হতে পারে। যদি ঐ “আলিফ” অক্ষরটি তেলাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে তার অর্থ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যাবে আর তা হবে এই যে, কিংবা আমি তাকে হত্যা করব না।
আশ্চর্য বিষয় হলো, যখন কুরআন মাজীদে যের, যবর, পেশ ছিল না, নুক্তা (ফোটা) ছিল না তখন আয়াতের এ অংশটি অতিরিক্ত (আলিফ)সহ অপরিবর্তিত অর্থ নিয়ে ইসলামের শত্রুদের হাতে কীভাবে নিরাপদ ছিল? অথচ সর্বকালেই কাফেররা কুরআন মাজীদে পরিবর্তনের অপচেষ্টা চালিয়েছিল।
৬. এ বাক্যটি কুরআন মাজীদে দুবার এসেছে, ১ম বার সূরা আনকাবুতে ২য় বার সূরা যুমারে। সূরা আনকাবুতে শব্দটি “ইয়া” অক্ষরসহ লিখিত হয়েছে। যেমন: আয়াত নং- ৫৬
আবার সূরা যুমারে এ বাক্যটি “ইয়া” অক্ষর ব্যতীত এভাবে লিখিত হয়েছে, আয়াত নং- ১০।
উভয় পদ্ধতির অর্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। লিখার এ পার্থক্য ১৪শ বছর থেকে কুরআন মাজীদের প্রতিটি কপিতে এভাবেই বিদ্যমান আছে। “ইয়া” অক্ষরের এ সাধারণ পার্থক্যটি আজ পর্যন্ত কোনো মুসলমান বা অমুসলিম কোনো প্রকাশক পরিবর্তন করতে পারেনি এবং কিয়ামত পর্যন্ত বদলাতেও পারবে না।
৭. কুরআন মাজীদে “লাইল” শব্দটি ৭৪টি স্থানে উল্লেখ আছে, নিয়ম অনুযায়ী “লাইল” শব্দটিতে তার পূর্ববর্তী শব্দের সাথে মিলাতে হলে আরেকটি “লাম” অক্ষর যোগ করতে হয়। যেমন: কুরআন মাজীদের অন্যান্য শব্দগুলো “লাম” অক্ষর যোগ করা হয়েছে, যেমন - সূরা আম্বীয়া -৫৫। বা সূরা মুরসালাত -৩১। কিন্তু “লাইল” শব্দটি সমগ্র কুরআনের একটি “লাম” যোগে ব্যবহার হয়েছে। যা লিখার পদ্ধতি অনুযায়ী সঠিক নয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি কুরআন মাজীদে “লাইল” শব্দটিতে আরেকটি “লাম” যোগ করতে পারেনি।
৮. কুরাআন মাজীদের সমস্ত সূরাসমূহের শুরুতে বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা হয়েছে, কিন্তু সূরা তাওবার শুরুতে উল্লেখ নেই, তার কারন হলো এই যে, রাসূল (সা:) এ সূরা লিখানোর সময় তার শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখাননি। তাই ১৪শ বছর থেকে পৃথিবীর সমস্ত মাসহাফে (কুরআনে) এ বিসমিল্লাহ সূরাটি ব্যতীতই লিখিত হয়ে আসছে। কোনো বন্ধু বা শত্রুর এ সাহস হয়নি যে, তারা সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখবে।
৯. সূরা ক্বাহাফে মূসা (আ.) এবং খিজির এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যে, তাঁরা উভয়ে একটি এলাকাতে পৌঁছার পর সেখানকার লোকদের নিকট খাবার চাইল, কিন্তু তারা খাবার দিতে অস্বীকার করল, কুরআন মাজীদের ভাষায় অর্থ: “তারা অস্বীকার করল।”
খলীফা ওলীদ ইবনে আবদুল মালেকের সময়ে যখন কুরআন মাজীদে নুক্তা (ফোটা) যোগ করা হলো তখন কেউ কেউ বলল, এর পরিবর্তে শব্দ লিখার পরামর্শ দিল যার অর্থ হয়: তারা খাবার দিল। যাতে করে আপ্যায়ন করাতে অস্বীকার করার স্থলে আপ্যয়ন করাল, আর এলাকাবাসীরা তাদের বদনাম থেকে বেঁচে যাবে।
তখন ওলীদ ইবনে আব্দুল মালেক বলল, “কুরআন মাজীদ তো অন্তর থেকে অন্তরে স্থানান্তরিত হয়।” (অর্থাৎ যা হাফেজদের অন্তরে সংরক্ষিত থাকে এবং তারা তাদের ছাত্রদের অন্তরে শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে স্থানান্তরিত করে।)
অতএব, কাগজের পরিবর্তন কোনো কাজ হবে না। তাই তা যেমন ছিল তেমনই থাকতে দাও। গত ১৪শ বছর থেকে কাফেরদের সর্বপ্রকার শত্রুতা এবং কুচক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও কোনো কট্টরপন্থি কাফেরও কুরআন মাজীদে কোনো একটি শব্দ বা অক্ষর বা কোনো যের বা যবর এমনকি ফোটার কোনো পরিবর্তন আনতে পরেনি, আর কিয়ামত পর্যন্ত কোনো দিন পারবেও না।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন-
অর্থঃ “আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক”। (সূরা হিজর: আয়াত-৯)
আর এ বাণীর কার্যকারিতা গত ১৪শ বছর থেকে চলে আসছে।
আব্বাসী খলীফা মামুনুর রশীদের শাসনামলে কুরআন সংরক্ষণ সংক্রান্ত ঘটনাবলি নিঃসন্দেহে পাঠকদের মনঃপূত হবে।
মামুনুর রশীদ তার শাসনামলে জ্ঞান চর্চার মূল্যায়ন করত, যেখানে সকলেরই প্রবেশাধিকার ছিল। একটি বৈঠকে একজন ইহুদী উপস্থিত ছিল, তার জ্ঞানগর্ভ এবং সাহিত্যপূর্ণ আলোচনায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে খলীফা মামুনুর রশিদ ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দাওয়াত দিল। কিন্তু ইহুদী তা প্রত্যাখ্যান করল। এক বছর পর ঐ ইহুদী আবার ঐ বৈঠকে উপস্থিত হলো কিন্তু এ সময়ে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে মামুনুর রশীদ তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমার হাতের লিখা সুন্দর, আমি বই লিখে বিক্রি করি। আমি পরীক্ষামূলকভাবে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করেছি। সেখানে বহু স্থানে আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে কম বেশি করেছি এবং এ কপি নিয়ে ইহুদীদের গীর্জায় গিয়েছি। ইহুদীরা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে তা ক্রয় করেছে। এরপর ইঞ্জিলের তিনটি কপি পরিবর্তন করে লিখে তা চার্চে নিয়ে গেলাম এবং খ্রিস্টনদের নিকট তা বিক্রি করলাম। এরপর কুরআন মাজীদের তিনটি কপি নিলাম এবং এখানেও ঐভাবে কম বেশি করে লিখলাম এবং মসজিদে নিয়ে গিয়ে তা মুসলমানদের নিকট বিক্রি করে দিলাম। কিন্তু এ তিনটি কপিই খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হলো এ বলে যে, এটাতে পরিবর্তন করা হয়েছে, অথচ তাওরাত এবং ইঞ্জিলের সমস্ত কপি বিক্রি হয়েছে এবং কোনো কপিই ফেরত আসেনি।
এ ঘটনার পর আমার বিশ্বাস জন্মালো যে, সত্যিই কুরআন মাজীদ আল্লাহ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই আমি মুসলমান হয়ে গেলাম।
ওসমান (রা.)-এর শাসনামলের পর
ওসমান (রা.) কুরআন মাজীদের যে কপিটি প্রস্তুত করিয়েছিলেন তা ছিল যের, যবর, পেশ এবং নোক্তা (ফোটা) বিহীন। আরবী ভাষীদের জন্য এ ধরনের কুরআন তেলাওয়াত করা ততটা কঠিন ছিল না। কিন্তু অনারবদের জন্য তা যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। বলা হয়ে থাকে যে সর্বপ্রথম বসরার গভর্নর যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান একজন আলেম আবুল আসওয়াদ আদদুয়াইলীকে এ বিষয়ে একটি সমাধান খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি অক্ষরগুলোর ওপর নোক্তা (ফোটা) দেয়ার পরামর্শ দিলেন এবং তা করা হলো। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান (৬৫-৮৬ হিঃ) তার শাসনামলে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবনে ইয়ামার এবং নাসার বিন আসেম লাইসী ও হাসান বাসরী (রাহিমাহুমুল্লাহর) পরামর্শক্রমে যের, যবর, পেশ সংযোগ করেছে। আবার বলা হয়ে থাকে যে, হামযা এবং তাশদীদের আলামতসমূহ খালীল ইবনে আহমদ (রা.) স্থাপন করেছেন।
সাহাবা এবং তাবেয়ীনগণের অভ্যাস ছিল যে, তাঁরা সপ্তাহে একবার কুরআন মাজীদ খতম করতেন। এ উদ্দেশ্যে তারা পূর্ণ কুরআন মাজীদকে সাত ভাগে ভাগ করেছেন, যাকে হিযব বা মানজীল বলা হয়। মূলত এই হিযব বা মানজীলের ভাগ সাহাবায়ে কিরামের যুগে হয়েছিল। অবশ্য কুরআন মাজীদকে ত্রিশ পারায় ভাগ করা, প্রত্যেক পারাকে চার ভাগে ভাগ করা অর্থাৎ চতুর্থাশে, অর্ধেক, তৃতীয়াংশ, এমনকি রুকুর আলামত, আয়াত নাম্বার, ওয়াকফ (থামার চিহ্ন) যোগ করা ইত্যাদি মাসহাফ উসমানী তথা উসমান (রা.)-এর যুগে একত্রিতকৃত কুরআনের পরে করা হয়েছে। যার সংযোজন একমাত্র কুরআন মাজীদের তেলাওয়াত এবং মুখস্থ করাকে সহজ করার জন্য করা হয়েছে। কুরআন মাজীদ অবতীর্ণের সময়কালের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং শরীয়তের দৃষ্টিতেও এর কোনো বিশেষ বিধান নেই। (এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন