মানুষের সেবা করার চেয়ে বড় কোনো ইবাদাত নেই। ভুখা মানুষদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার এই চেষ্টায় নিশ্চয়ই আল্লাহ খুশি হবেন। আমাদের ঈমানের একটি বড় পরীক্ষায় আমরা পাস করে যাব। আল্লাহর নেয়ামতে নিশ্চয়ই তাতে অনেক বেশি বরকত মিলবে।
সারাবিশ্বের মুসলমানের আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর। রোজাদার যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়। এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন। আর এ আনন্দ ও পুণ্যের অনুভূতি জগতে এমন এক দুর্লভ জিনিস, যা ভাগাভাগি করলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায়। ঈদুল ফিতর আনন্দ-উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে।
ঈদ আরবি শব্দ। এটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা। মুসলমানদের জীবনে চান্দ্র বৎসরের নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি বছরই দু’টি উৎসবের দিন ফিরে আসে। তাই দিন দু’টিকে ঈদ বলা হয়। ফিতর শব্দের অর্থ হলো ভেঙ্গে ফেলা, বিদীর্ণ করা। মুসলমানরা রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা রাখা আরম্ভ করে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা ভেঙ্গে দেয় তথা রোজা রাখা ছেড়ে দেয়। সে কারণে এটিকে ঈদুল ফিতর তথা রোজা ভাঙ্গার আনন্দ বলা হয়।
ইসলামে ঈদের বিধান আসে হিজরতের পর। এর আগে মদিনাবাসী পারসিক প্রভাবে এমন কিছু উৎসব পালন করতেন, যেগুলোতে ছিল ইসলাম ও নৈতিকতাবিরোধী উপাদান। হাদীসে এসেছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীর দু’টো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু’দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসী উত্তর দিলেন, আমরা মূর্খতার যুগে এ দু’দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দু’দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হলো: ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ [আবু দাউদ : ৯৫৯]
পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জীবনেই উৎসব রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ উৎসব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠি-ধর্মের উৎসবের চেয়ে কিছুটা ভিন্নধর্মী। অন্যান্য জাতি-ধর্মের উৎসব হলো খাও দাও ফুর্তি কর। তাদের আনন্দ-উৎসব অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় ভরপুর। ইসলাম প্রবর্তিত আনন্দ-উৎসব ইহকালীন ও পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের ঈদ নিছক উৎসবই নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। এটিই ইসলামের সৌন্দর্য।
মুসলমানদের ঈদের ইহকালীন তাৎপর্য হলো, রমজান শেষে সাদাকাতুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার কুরবানীর চামড়া দিয়ে অসহায়-গরীবদের আর্থিক সহায়তার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অস্বচ্ছল পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দু’টি ঈদ যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। ঈদের পরকালীন তাৎপর্য হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজান মাসকে বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতে ভরপুর করেছেন। ঈদ নিছক আনন্দ-উৎসব নয়, এটি একটি ফযীলতপূর্ণ ইবাদত এবং সে কারণেই ঈদের রাতে এবং ঈদের দিনের অনেক ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদীসে।
হযরত আউস আল আনসারী রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সকল ফিরিশতা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে মুসলিমগণ! তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে আস। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সাওয়াব প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে আস। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাযের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামায পড়েছ। তোমাদেরকে দিনগুলোতে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছ, এক মাস রোজা রেখেছ। গরীব দুঃখীদের পানাহারের মাধ্যমে নিজ প্রতিপালককে তোমরা পানাহার করিয়েছ। এখন নামায পড়ার মাধ্যমে সেগুলোর প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর। ঈদের নামায পড়ার পর ফিরিশতাদের মাঝে একজন ঘোষণা দেন, শোন, নামায আদায়কারীরা! তোমাদেরকে মহান রাব্বুল আলামীন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আর শোন! এ দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন। আকাশে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে পুরস্কারের দিন।’ [আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদীস নম্বর : ৬১৭ ও ৬১৮]
ঈদুল ফিতর মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতে পরিণত হবে তাদের জন্য যারা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে রমজানের রোজা পালন করেছে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে উদ্দেশ্যে রমজানের রোজা ফরজ করেছেন সেই উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে রোজা রেখেছেন তথা তাকওয়া অর্জন করেছেন। যারা পাপমুক্ত জীবন গঠনের মানসিকতা অর্জন করেছে এবং যারা ইসলামের নির্দেশনার গন্ডির মধ্যে থেকে আনন্দ উৎসব পালন করেছে অর্থাৎ যাদের আনন্দ উৎসবে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা নেই। প্রকৃতপক্ষে এ ঈদ হলো এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপ্তি অনুষ্ঠান। পরবর্তী এগারো মাস সেই প্রশিক্ষণ অনুযায়ী জীবনের বাঁকে বাঁকে চলার এক সফল প্রতিশ্রুতি। তাই একদিকে ঈদুল ফিতর যেমন সিয়াম সাধনার সমাপ্তি ঘোষণা করে, অপর দিকে তা নির্মল আনন্দও বয়ে আনে। প্রকৃত রোজাদারদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘোষণা হলো, ‘যারা যথাযথভাবে সিয়াম সাধনা করে তারা ঈদের নামায শেষে নবজাতক শিশুর ন্যায় পাপমুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের জীবনে সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন’।
এবার এমন এক সময় ঈদুল ফিতর এসেছে, যখন বৈশ্বিক মহামারী করোনায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাশও আক্রান্ত। সরকার বলেই দিয়েছে, এমন পরিবেশে এবার ঈদের আনুষ্ঠানিকতা খুব সীমিত করা হবে। লোক চলাচল বন্ধ করতে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ থাকবে। যে যেখানে আছে, সেখানেই ঈদ পালন করার জন্য সরকার আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে। জীবন ও জীবিকার দ্বন্ধে বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলায় অনেক ঘাটতি সবার নজরে পড়েছে। আমরা গরিব দেশ। অতিরিক্ত জনভারে ন্যুব্জ। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো দুর্বল। জনসচেতনতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাই অনেক কিছুই এখানে বেশ এলোমেলো। রোগের ওপর বিষফোঁড়া হলো দুর্নীতি।
কয়েক কোটি মানুষ এখন কর্মহীন। সরকারের লক্ষ-কোটি টাকার প্যাকেজ চাহিদার তুলনায় সত্যিই অপ্রতুল। মানুষকে কাজে ফেরানো জরুরি। আবার তাতে রয়েছে প্রচন্ড ঝুঁকি। কিছু জরুরি সেবা যেকোনো মূল্যে চালু রাখতেই হবে। তাতেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যান্য দেশের নজির থেকে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ দৈনিক সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছানোর পর আরও প্রায় দুই সপ্তাহ মৃত্যুর মিছিল ঊর্ধ্বগামী থাকে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে দেশের সবাইকে করোনার ভয়াবহতা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে এবং করোনার এ বিপদে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
আসুন, আমরা এবারের ঈদ বিপন্ন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করতে পারি। যাকাত ও সদাকাতুল ফিতর আদায় করে গরীবের অভাব দূর করতে পারি। ঈদে কোনো বাড়তি খরচ না করে সে অর্থ আমরা ভুখা মানুষের জান বাঁচানোর জন্য দিতে পারি। একটা ঈদে আমরা কোনো পোশাক বা অন্য কিছু না কিনি, আমরা অতি সামান্য সেমাই আর স্বল্প পরিমাণ গোশত খেয়ে ঈদ পালন করতে পারি। সংক্রমণের কারণে অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে কেউ যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। মানুষের সেবা করার চেয়ে বড় কোনো ইবাদাত নেই। ভুখা মানুষদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার এই চেষ্টায় নিশ্চয়ই আল্লাহ খুশি হবেন। আমাদের ঈমানের একটি বড় পরীক্ষায় আমরা পাস করে যাব। আল্লাহর নেয়ামতে নিশ্চয়ই তাতে অনেক বেশি বরকত মিলবে। আসুন, এবারের ঈদ আমরা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই। সবার দুঃখে সমব্যথী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন