শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মিউনিখে সন্ত্রাসী হামলা

প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ১০ দিনের মাথায় প্রতিবেশী জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিউনিখের একটি শপিংমলে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাথমিক খবর অনুযায়ী ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে হামলাকারীর লাশও রয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, হামলাকারী তিনজন। পরে বলা হয়েছে, হামলাকারী একজন, যে সম্ভবত নিজের গুলিতেই প্রাণ হারিয়েছে। হামলাকারী ইরানি বংশোদ্ভূত বলে জানানো হয়েছে; এর বেশি কিছু উল্লেখ করা হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, চার দিন আগে আফগান বংশোদ্ভূত এক তরুণ ব্যাভেরিয়ায় একটি ট্রেনে কুড়াল নিয়ে হামলা চালায়, যাতে চারজন যাত্রী আহত হয়। মিউনিখের শপিংমলে হামলার পর জরুরি বৈঠক করেছে জার্মানি কর্তৃপক্ষ। চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলের চিফ অব স্টাফ জানিয়েছেন, কারা এবং কেন এ হামলা চালিয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। এটা সন্ত্রাসী হামলা নয়, তা উড়িয়ে দিতে পারছি না। আবার একে এখনই সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে নিশ্চিত করে বলতেও পারছি না। কোনো পক্ষ এখনো হামলার দায় স্বীকার করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং জার্মানির যে কোনো সঙ্কটে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। ১০ দিনে দুই প্রতিবেশী দেশে তিনটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা শুধু ফ্রান্স ও জার্মানিতেই নয়, ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। এর আগে ফ্রান্সসহ নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামীতে আরো হামলার ঘটনা ঘটতে পারে।
হামলার ধরনে একটি পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। নিসে হামলা এক ব্যক্তিই করেছে। তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি ট্রাক চালক একাই জনসমাবেশের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়ে হত্যাকা- ঘটিয়েছে। ব্যাভেরিয়ার ঘটনায়ও হামলাকারী একজন। মিউনিখে হামলাও এক ব্যক্তিই চালিয়েছে। এরা আইএস কিংবা অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের হয়ে এসব হামলা চালিয়েছে কি না তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। নিসের হামলার দায় আইএস স্বীকার করলেও ফ্রান্সের পাবলিক প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, তার সঙ্গে আইএসের সরাসরি সম্পর্কের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ব্যাভেরিয়া ও মিউনিখের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলে বোঝা যাবে, হামলাকারীদের সঙ্গে আইএস বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সম্পৃক্ততা আছে কি না। উল্লেখ করা যেতে পারে, আইএস, আল-কায়েদা প্রভৃতি সন্ত্রাসী সংগঠন ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলোকে প্রথম সারির ক্রুসেডার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে হামলা ও নাগরিক হত্যার ডাক দিয়েছে। এ কারণে ইউরোপে কোনো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলে প্রথমেই আইএস বা আল-কায়েদার দিকে আঙুল উত্থিত হয়। কোনো কোনো ঘটনায় তাদের দায় স্বীকার আঙুল তোলার পক্ষে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যখন এক ব্যক্তি হামলার হোতা বলে চিহ্নিত হয় এবং তার সঙ্গে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সরাসরি সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন ব্যক্তির ভূমিকাই মুখ্য হয়ে ওঠে এবং তার অবস্থা, অবস্থান ইত্যাদি প্রাধান্যে চলে আসে। উল্লেখিত তিন হামলার ঘটনায় জড়িতরা মুসলমান নামধারী এবং তিনটি মুসলিম দেশ থেকে আগত, যারা ফ্রান্স ও জার্মানির নাগরিকও বটে। তারা কেন আশ্রয় প্রদানকারী, নাগরিকত্ব প্রদানকারী দেশে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ে জড়িত হবে, সেটাও গভীরভাবে খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। তাদের অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ, হতাশা, বঞ্চনা কোথায় তা খুঁজে বের করা আবশ্যক।
গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের যে চেহারা আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা একমত যে, এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপই প্রধানত দায়ী। গত দেড় দশকে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিচক্র যে নজিরবিহীন হামলা, আগ্রাসন, হস্তক্ষেপ, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছে তাতে ওই দেশগুলোর মানুষের মধ্যে চরম অসহায়ত্ব ও হতাশার সঙ্গে সঙ্গে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভও সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থীর যে স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তার জন্যও সাম্রাজ্যবাদীদের অপকর্মই দায়ী। এই প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই সন্ত্রাসবাদী হামলা ও হামলার আশঙ্কা থেকে যদি বিশ্বকে মুক্ত রাখতে হয়, তাহলে প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে চলমান নীতি-অবস্থান পরিত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে ওইসব দেশে বসবাসকারী অভিবাসী নাগরিকদের প্রতি সমআচরণ করতে হবে। বলা আবশ্যক, ইসলাম কোনোরূপ সন্ত্রাস ও সাধারণ মানুষ হত্যা সমর্থন করে না। এ পর্যন্ত যত সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে তাতে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে মুসলমানরা। হামলার ঘটনাও মুসলিম দেশগুলোতেই বেশি হয়েছে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও শিকার হয়েছে মুসলমানরা। গোটা বিশ্বে হেট মুসলিম ক্যাম্পেইনের কারণে মুসলমানরাই সবচেয়ে বিপাক ও বিড়ম্বনার মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসী হামলার সব থেকে বড় প্রতিবাদকারীও মুসলমানরাই। এ সত্যটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে এবং মুসলমান মাত্রকেই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা পরিহার হবে। আমরা সঙ্গতকারণেই মিউনিখে হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। যারা হতাহত হয়েছে, তাদের পরিবার-পরিজন, সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। যুদ্ধ, আগ্রাসন, গণহত্যা, ধ্বংযজ্ঞ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে তারা বেরিয়ে আসবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন