বৈশ্বিক মহামারী করোনায় ক্রমবর্ধমান হারে শুধু মানুষই মারা যাচ্ছে না, একই সঙ্গে তা বিশ্ব অর্থনীতিকেও ধমিয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতি মহামন্দার সম্মুখীন, যা অতীতের সব মহামন্দাকেই ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব মোকাবেলার বিষয়টি নিয়ে তাই এখনই ভাবতে হবে। ভাবতে হবে করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠন নিয়েও। ভয়াবহ মন্দার কারণে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হবে। ইতোমধ্যে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তাতে ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের এই সহযোগী সংগঠন বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট আর আসেনি। গত বছর ডিসেম্বরে আড়াই কোটি মানুষের নতুন করে বেকার হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল আইএলও। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দীর্ঘ হওয়ায় সেই পূর্বাভাস আর টিকছে না। এছাড়া ২০২০ সালে দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলো ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এটি প্রায় ২০ কোটি পূর্ণকালীন কর্মজীবী মানুষের চাকরি হারানোর বাস্তবতা সৃষ্টি করবে।
উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। এসব দেশে উন্নয়নের পথে বড় বাধা হলো বেকারত্ব। করোনার প্রভাবে বিশ্বের ছোট, বড় এবং মাঝারি সব ধরনের শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ক্ষত সারিয়ে নিতে অনেকেই কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে পৃথিবীর সামনে এক বিশাল বেকারত্ব নামক একটি সমস্যা অপেক্ষা করছে। বেকারত্বের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সামাল দেয়া তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হবে না। কারণ বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যা বছরের পর বছর চেষ্টার ফল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২ কোটি ২২ লাখ নাগরিক বেকার ভাতা দাবি করেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বেকার সমস্যা পৃথিবীকে ঘিরে ধরছে। আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে শুরু হয়েছে মন্দা। এ মুহূর্তে উদীয়মান দেশগুলোর প্রয়োজন আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি এই মন্দা ২০২১ সালে সামলে উঠা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন। করোনার প্রভাবে বিশ্বের ১৭০টি দেশের মাথাপিছু আয়ে ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছেন তিনি। বিশ্ব অর্থনীতির মূল ধাক্কাটা যাবে কর্মী ছাঁটাইয়ের মধ্যে দিয়ে। বৈশি্বক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক চীন, আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস অর্থনীতিতে ধ্বস নামিয়েছে। করোনাভাইরাসের মারাত্বকভাবে বিস্তার হওয়া আরেক দেশ স্পেনেও ইতোমধ্যেই চাকরির বাজারকে ভয়ানক থাবার শিকারে পরিণত হয়েছে।
গত মার্চে স্পেনে বেকারত্বের সংখ্যা এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশিতে দাঁড়ায়। দেশটির সরকারি হিসাবে বর্তমানে স্পেনে বেকারত্বের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ। এর অর্থ এক মাসেই বেকারত্বের হার ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্পেনে লকডাউনের শুরু থেকে ৮ লাখ ৯৮ হাজার ৮২২ জন মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ ৫০ হাজার অস্থায়ী কর্মী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন করোনার প্রভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্থ। এছাড়া বিশ্বের কয়েক দেশ বাদ দিলে সব দেশেই করোনাভাইরাস প্রাণহানির সাথে সাথে অর্থনীতিকেও স্থবির করে দিচ্ছে। এর প্রভাবে দোকানপাট, বিমান চলাচল সব বন্ধ থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে নিরাপত্তাই মুখ্য সেখানে এর থেকে ভালো উপায় হয় না। এর ফলে আর্থিক বিশ্বমন্দার বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির একটি দিক চাকরির বাজার, যা অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত করতে পারে। করোনার কারণে এই দিকেও টালমাটাল অবস্থার তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে। শুরুতে চীনের অবস্থা সবচেয়ে বেশি সংকটজনক ছিল। তবে চীন এখন অনেকটাই এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে পেরেছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য চীনসহ সারাবিশ্বই আপ্রাণ চেষ্টা করছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি যদি দ্রুত স্বাভাবিক না হয় তাহলে তা অর্থনীতিকে আরো ক্ষতির মুখে ফেলবে। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করবো। কীভাবে চাকরির বাজার সুরক্ষা করবো আর যেখাতগুলো লোকসানের কবলে পড়বে সেগুলোকে কীভাবে আবার আগের জায়গাতে ফিরিয়ে আনবো। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রকৃতপক্ষে এমন একটি বিষয় যেখানে এক দেশ অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। তা যদি আমেরিকা ও চীনের মতো শক্তিশালী বাণিজ্য সক্ষমতাসম্পন্ন দেশ হয় তাহলে তা আরও বেশি প্রভাব ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। নিত্য নতুন প্রযুক্তিপণ্যে খুব দ্রুত বিশ্বে নিজের অবস্থান সুসংহত করে নেয়া দেশ হলো চীন। যার প্রযুক্তিপণ্য বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের একটি বড় অংশ পূরণ করছে।
আমাদের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হলো গার্মেন্ট খাত যা এখন কোনো রকমে চলছে। পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর কর্মসংস্থানের একটি বিশাল অংশ। সম্ভাবনাময় এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এই খাতে রপ্তানি করে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই পোশাক। ইউরোপ এবং আমেরিকায় করোনার প্রভাবের কারণে রপ্তানিতে প্রভাব পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাব একসময় স্তিমিত হয়ে আসবে। বিশ্ব চেষ্টা করবে ঘুরে দাঁড়াতে। বিগত মহামন্দার পরেও বিশ্ব ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। লক্ষ রাখতে হবে, এই সময়টায় কারও চাকরি যেন না যায়। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কর্মী ছাঁটাই স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থা বজায় রাখতে হলে অর্থনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। করোনার প্রভাবে অর্থনীতির গতি ধীর হওয়ার অবস্থা রুখতে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যের ওপরও জোর দিতে হবে। তবে এ ধাক্কা কেবল একদিক থেকে আসবে না। প্রযুক্তিপণ্য, গার্মেন্টপণ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, এমনকি যোগাযোগ ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে। এমনিতেই দেশের বেকার সমস্যা দূর করার জন্য সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েও কিনারা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এখন যদি এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায় তাহলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। তাই বেকারত্বের সমস্যা দক্ষ হাতে সামাল দিতে হবে।
লেখক: শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন