মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

৬ দফা থেকে স্বাধীনতা

সেলিনা হোসেন | প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২০, ১২:০২ এএম

আজ ৭ জুন। ১৯৬৬ সালের এই দিনে প্রবল প্রতিরোধে তখনকার পূর্ববাংলায় পূর্ববঙ্গবাসী বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত ৬ দফার স্বীকৃতির জন্য রাজপথে নেমেছিল প্রবল প্রতিরোধে। বাঙালির অধিকার বিমূর্ত হয়েছিল ৬ দফার দাবিতে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কৈশোর থেকে সূচিত রাজনৈতিক জ্ঞানের ধারাবাহিকতায় তৈরি করেছিলেন বাঙালির অধিকার সচেতনতার মূল সূত্র ৬ দফা কর্মসূচি। তিনি এই রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞকে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি’ শিরোনামে পাকিস্তানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে আইয়ুব খানের বিরোধী দলগুলো একটি বৈঠকে বসে। এই সভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক নেতারা ৬ দফা দাবিকে সমর্থন করেনি। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশই নানাভাবে শোষিত বঞ্চিত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হলে সবাই সন্ত্রস্থ হয়ে যায়। তারা ৬ দফাকে পাকিস্তানকে ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে এবং এর তীব্র বিরোধিতা করে।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৭ দিন যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানকে একদম অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্রের এমন অবস্থা ছিল না যে ভারতের আক্রমণের মোকাবেলা করতে পারত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন এভাবে যে, চীনের ভয়ে ভারত পূর্বপাকিস্তানে যুদ্ধে জড়াতে সাহস করেনি। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে ১৭ দিন যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেওয়ার মতো অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব বাংলার ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেই হয়।’
বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রবলভাবে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন। তিনি পূর্বপাকিস্তানবাসীর অধিকারের ৬ দফা দাবি প্রণয়ন করেন।
লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পরে সাংবাদিকদের ৬ দফার ব্যাখ্যা দেন। এই ৬ দফাকে বাঙালির মুক্তিসনদ বলে উল্লেখ করেন। এরপর তিনি ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি জেলায় জনসমাবেশ করেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে ৬ দফার কথা শোনেন। এই ৬ দফার শেষ দফায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন।
তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে যে বক্তৃতা করেন তার শুরুটা এমন:
‘আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ৬ দফা কর্মসূচি দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমি স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ-হৈ করিয়াই উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবি, যুক্ত-নির্বাচন-প্রথার দাবি, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প-ব্যয়ে শিক্ষা-লাভের দাবি, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতেও এঁরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণির সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি- তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে।’
তিনি শেষ করেছেন এভাবে, ‘আমার প্রিয় ভাই-বোনেরা, আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬ দফা দাবিতে একটিও অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্ক সহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুনও নয়, বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ-দাদার মতো মুরুব্বিরাই এদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি কোন ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমণি শেরে বাংলা ফজলুল হককে এরা দেশদ্রোহী বলিয়াছেন। দেশবাসী এও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল এদেরই হাতে। অতএব, দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল-জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তক্দির আমার হইয়াছে। মুরুব্বিদের দোওয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সেসব সহ্য করিবার মতো মনের বল আল্লাহ্ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালোবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে-কোনও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তাঁহার পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাই-বোনেরা আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকি জীবনটুকু আমি যেন তাঁহাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি-সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।
আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম, শেখ মুজিবুর রহমান।’
১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করার পরে দেশরক্ষা আইনের ৩২ নম্বর ধারায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সাংবাদিকদের বলতেন, ‘আমি যতদিন গভর্নর, শেখ মুজিবকে জেলেই থাকতে হবে।’
৬ দফা কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পরে ব্যাপক আকার ধারণ করে। জনগণ মিছিলে গণআন্দোলনের প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হয়। প্রায় আটশত লোককে গ্রেফতার করে মোনেম খান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ৬ দফার সমর্থনে হরতাল পালন শুরু করে। ছাত্রজনতা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে ১৪৪ ধারা জারি করে গভর্নর। স্লােগান ওঠে ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনব।’ এই সময় শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়।’ প্রবল প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গবাসী। আওয়ামী লীগ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে’ প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশের নির্যাতনে শহীদ হয় অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত করে। এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান পরে শহীদ হয় স্কুলছাত্র মতিউর রহমান। শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের চাপে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ সামরিক শাসক আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পুরো পাকিস্তানে দ্বিতীয় বারের মতো সামরিক শাসন জারি হয়। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করে। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী না করার জন্য ষড়যন্ত্র করে। ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিলেন। ৫ বছরের ব্যবধানে তিনি স্বাধীন দেশের স্থপতি হন।
[পিআইডি ফিচার]

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন