শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দুর্নীতি নিরোধের কাজ ওপর থেকেই শুরু করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল ইনু বলেছেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থ চুরি হয়ে যায়। তার ভাষায়, টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের ৮০ শতাংশই চুরি হয়। ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলে ১৫০ কোটি টাকা (অর্ধেক) যায় এমপিদের পকেটে। বাকি ১৫০ কোটি টাকার বেশিরভাগ যায় স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পকেটে। আমরা চোখ বন্ধ করে এ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। হাসানুল হক ইনু, বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তিনি যথাযথ দায়িত্বশীলতা নিয়েই এ বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বিবেচনায় তার এই বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা চুরি হচ্ছে, এই দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, আমি হিসাব করে দেখেছি, যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়, সেই টিআর-এর অর্থ দিয়ে সোনার মসজিদ বানিয়ে দেয়া যায়। অর্থমন্ত্রীর কাছে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, আমাদের সম্পদের সমস্যা অথচ সম্পদ ছিটিয়ে দিচ্ছেন। কাকে দিচ্ছেন? একজন আমলাকে বড়লোক করার জন্য? একজন এমপিকে বড়লোক করার জন্য। উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বড়লোক করার জন্য? হাসানুল হক ইনুর মতো একজন নেতা ও মন্ত্রী এসব কথা বলেছেন বলেই নয়, দেশের ওয়াকিবহাল মহল তো বটেই অতিসাধারণ মানুষও জানে, টিআর-কাবিখাই নয়, সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের একটা বড় অংশই মন্ত্রী-এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে চলে যায়। এর অনিবার্য ফল হিসেবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেমন যথাসময়ে শেষ হয় না, জনগণ প্রকল্পের সুফল পায় না বা বিলম্বে পায় তেমনি জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়। লাভ হয় কেবল কতিপয় ব্যক্তির। সব উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্যই জনগণের কল্যাণ ও উন্নতি, কতিপয় ব্যক্তির ফুলে-ফেঁপে ওঠা নয়।
এমপিরা জনপ্রতিনিধি, আইন প্রণেতা। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য তাদের উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। আর যাবতীয় উন্নয়ন কার্যাবলি পরিচালিত হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে। এখন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের বেশিরভাগই যদি এমপির পকেটে যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পকেটে যায়, পকেটে যায় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। তাহলে জাতীয় উন্নয়ন-আকাক্সক্ষা কিভাবে পূরণ হবে, কিভাবে জনগণ তার সুফলভোগী হবে? পাকিস্তান আমলে বলা হতো, ইউনিয়ন পরিষদের বরাবরে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাতে দেশের সব ছোট-বড় রাস্তা পাকা হয়ে যাওয়ার কথা। তখন এটি হয়নি। সাত ভূতে সব মেরে খেয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, টিআর-এর বরাদ্দে ‘সোনার মসজিদ’ হতো। তা হয়নি। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, দুর্নীতি ও টাকা মারার ‘কালচারে’ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অনেকের মতে, পাকিস্তান আমলের চেয়েও দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতির একটা ‘জাতীয়করণ’ হয়ে গেছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি বিস্তৃত ও স্থায়ী আসন লাভ করেছে। সরকারের এমন কোনো বিভাগ নেই, এমন কোনো অফিস নেই, এমন কোনো কাজ নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই, অনিয়ম নেই। ঘুষ ছাড়া, পার্সেন্টেজ ছাড়া, বখরা ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হয় না। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবছর দুর্নীতির যে রিপোর্ট ও চিত্র তুলে ধরে, সেটাই এর সাবুদ হিসেবে যথেষ্ট। সেখানে দেখা যায়, এমন কোনো বিভাগ বা ক্ষেত্র নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার রুখে দেয়া সম্ভব না হলে প্রত্যাশিত জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি কখনোই হবে না, এটা নিশ্চিত।
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিয়েও নানা কথা আছে। দুর্নীতির অর্থ সমাজে বিষম অবস্থা সম্প্রসারিত করছে। এতে নানামাত্রিক সামাজিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা সেখানে এই অর্থ বিনিয়োগ করছে, সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে। দুর্নীতির অর্থ জঙ্গিবাদে যাচ্ছে এমন তথ্যও সম্প্রতি দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি দেশ ও সমাজকে কোথায় নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, এসব থেকেই তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, দুর্নীতিকে নানাভাবে ‘প্রশ্রয়’ দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেক কিছুর ব্যাপারে সরকার সোচ্চার, তৎপর কিন্তু দুর্নীতি রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ-তৎপরতা নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে প্রশ্ন ও সমালোচনার অন্ত নেই। সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের মেগা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। অথচ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অবিনাশী কীট-দুর্নীতির অনুপ্রবেশের পথ বন্ধ করছে না, অবস্থিত দুর্নীতি নিরোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর ফলস্বরূপ এসব বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের একাংশ লুটপাট হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা বিভিন্ন মহল থেকেই করা হচ্ছে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা লড়াই দরকার, যাতে এর লাগাম টেনে ধরা যায় বা নির্মূলন সম্ভবপর হয়। আর বলাই বাহুল্য, দুর্নীতি নিরোধের কাজটি উপর থেকেই শুরু করতে হবে। মন্ত্রী-এমপি, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের পর্যায় থেকেই শুরু করতে হবে। নিচ থেকে শুরু করলে সুফল পাওয়া যাবে না। উপরে দুর্নীতি বন্ধ হলে আপনাআপনিই নিচে বন্ধ হয়ে যাবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন