লকডাউন মানে ঢাকার গলিপথে বাঁশ দিয়ে ‘লক’ করে পথচারীদের মাথা ‘ডাউন’ (নিচু) করে চলাফেরায় বাধ্য করা। গত ২৬ মার্চ অফিস-গণপরিবহন বন্ধের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ভাবে রাজধানীর লকডাউনের চিত্র তুলে ধরা হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এই উক্তি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলার হালচাল। করোনার সামাজিক ট্রান্সমিশন ঠেকাতে লকডাউনের নামে প্রথম থেকেই কার্যত চলছে টম-জেরি খেলা। লকডাউন নিয়ে সরকারের মধ্যেই এখনো মতভেদ রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা শহর পুরোপুরি বা অঞ্চলভিক্তিক লকডাউন কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ জেলা পর্যায়ের কোনো এলাকা লকডাউন আর দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকা লকডাউন এক বিষয় নয়।
এই অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের পরামর্শ ও তদারকির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কী ব্যবস্থা আছে, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে দেশের হাসপাতালে কতগুলো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ বেড) রয়েছে সেটাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, কারফিউ না দিয়েও পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যেত। যেমন শুরুর দিকে শিবচরে কঠোর লকডাউন দিয়ে সফলতার নজির রয়েছে। সংক্রমণের হটস্পট ঢাকায় লাল, হলুদ সবুজ এলাকা ঘোষণা এবং তার বাস্তবায়ন খুবই জটিল। আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি তারা হয়তো মতিঝিল অফিস করি, উত্তরায় থাকি। এখন উত্তরা যদি গ্রিন জোন হয় আপনি রেড জোনে এসে আপনি অফিস করতে পারবেন কি না এগুলো একটু জটিল সিদ্ধান্ত। আবার রেড জোনে সব নিয়মকানুন যদি শতভাব পালন করা না যায় তাহলে দেখা যাবে যে গ্রিন জোনে যাওয়ার জন্য মানুষ আকুল হয়ে থাকবে। আবার ছুটতে শুরু করবে। এগুলোতো চ্যালেঞ্জ বটেই।
ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে করোনা মোকাবিলা সবকিছুতেই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোর সমম্বয়হীনতার পাশাপাশি সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের অভাবে ক্রমাস্বয়ে করোনার সামাজিক ট্রান্সমিশন বেড়েই চলছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। করোনা যে গতিতে ডালপালা ছাড়াচ্ছে সে গতিতে নিয়ন্ত্রণের চেস্টা এবং পরীক্ষা হচ্ছে না। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে গত তিন মাসে করোনা নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৪ লাখ ১০ হাজার ৯৩১টি। গতকাল একদিনে সর্বোচ্চ পরীক্ষা করা হয় ১২ হাজার ৯৪৪টি। এতে আক্রান্ত হন ২ হাজার ৭৩৫ জন। সবমিলে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৮ হাজার ৫০৪ জন। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবেই করোনা পরীক্ষার আগ্রহ। কিন্তু সে তুলনায় পরীক্ষা হচ্ছে খুবই কম। পরীক্ষা আরো কয়েকগুণ বাড়ানো উচিত। পরীক্ষা বৃদ্ধি করলে সংক্রমণের প্রকৃতচিত্র পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে করোনার সামাজিক ট্রান্সমিশন ব্যাপকভাবে বাড়ছে। পৃথিবীজুড়ে আক্রান্তের শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারের রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যে দেখা যায়, গত ৮ মার্চ ৩ জন করোনা রোগী শনাক্তের পর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে আক্রান্ত হয় ২১৮ জন। পরের মাস তথা ৮ মে পর্যন্ত আক্রান্ত হন ১৩ হাজার ১৩৪ জন। পরের মাসে তথা ৮ জুন পর্যন্ত সারাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৬৮ হাজার ৫০৪ জন। দেশে প্রথম করোনা রোগী মারা যায় ১৮ মার্চ। প্রথম এক মাসে মারা যান ২০ জন। দ্বিতীয় মাসে মারা যায় ১৮৬ জন। তৃতীয় মাসে মারা গেছেন ৬৮২ জন। সরকারি হিসেবে মতে এখন পর্যন্ত সারাদেশে করোনায় মারা গেছে ৯৩০ জন। এ সসময়ে সুস্থ হয়েছেন ১৪ হাজার ৫৬০ জন। আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার চিত্র কার্যত ভয়াবহ। সে তুলনায় সুস্থ হওয়ার সংখ্যা কম।
সরকার এখন পরিকল্পনা করছে সারাদেশের আক্রান্ত এলাকাগুলো লাল, হলুদ এবং সবুজ জোনে চিহ্নিত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে। করোনা সংক্রমণের ক্রম অবনতির মধ্যে পহেলা জুন সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা বৈঠক করেন। ওই সভার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, করোনা সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, বেশি আক্রান্ত এলাকাকে রেড, অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত এলাকাকে ইয়েলো ও একেবারে কম আক্রান্ত বা মুক্ত এলাকাকে গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রেড জোনকে লকডাউন, ইয়েলো জোনে যেন আর সংক্রমণ না বাড়ে সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে। সতর্কতা থাকবে গ্রিন জোনে। করোনার জোন ভাগ করা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেছেন, রেড, গ্রীন এবং ইয়োলো জোনের ব্যাপারটা আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করছি। আমরা কিন্তু জানি ঢাকা কিন্তু রেড জোনের মধ্যে। ৫৪ শতাংশ কেইস ঢাকা মহানগরীর মধ্যে আর ঢাকা জেলার মধ্যেই দেশের সবচেয়ে বেশি কেইস।
এদিকে ঝুঁকি বিবেচনায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকাকে তিন রংয়ে ভাগ করা হয়। রাজধানী ঢাকায় প্রতি এক লাখ মানুষের ৩০ কিংবা ৪০ জনের বেশি আক্রান্ত এমন এলাকাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেড বা লাল জোনে চিহ্নিত করে পুরোপুরি লকডাউন ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের দুটি এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। রাজধানীর পুনার ঢাকার ওয়ারি ও ধানমন্ডির রাজাবাজার ৭ জন থেকে লকডাউন থাকবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। গতকাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকা রেডজোন ঘোষণা করা হচ্ছে। রাত ১২টায় এটি কার্যকর হবে। কিন্তু মন্ত্রি পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে কেবিনেটে কোনো আলোচান বা নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রযুক্তি ব্যবহার করে জোনিংয়ের মাধ্যমে লকডাউনকে উৎসাহিত করেছেন। রেড জোন ঘোষণা করাটা সবার জন্যই ভালো। কারণ এতে মানুষ সতর্ক হতে পারবে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলন, বাংলাদেশের একটা জেনারেল কন্ডিশন হলো, ভাইরাসটা আগে আগে যাচ্ছে বাংলাদেশে পিছে পিছে। সংক্রমণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। যে অবস্থা তাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এতে আমাদের ভুগতে হবে। অনেক মানুষ সংক্রমিত হয়ে যাবে। মানুষ সংক্রমিত হয়ে গেলে হাসপাতালের বেড বাড়াতে হবে, সুবিধা বাড়াতে হবে। সেদিক থেকেও খুব বেশি অগ্রগতি নেই।
লকডাউনে এক নগরে জোন : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন, ইয়োলো জোন ও গ্রিন জোনে ভাগ করা হচ্ছে। তিনটি জোনের জন্যই কিছু কিছু বিষয় অবশ্যক রয়েছে। সেগুলো যেকোনো স্থানেই মেনে চলতে হবে। প্রত্যেকের মাস্ক পরা, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে তিনটি জোনেই। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত, তার চিকিৎসা ও আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থা থাকবে সব জোনেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও চালু থাকবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় জরুরি পরিষেবা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে মাঠে।
রেড জোন: এক লাখে ৩০ জনের বেশি সংক্রমিতহলেই সে এলাকাকে ‘রেড জোন’ (ঝুঁকিপূর্ণ) চিহ্নিত করা হবে। রেড জেনে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প উন্মুক্ত থাকবে তবে শহরাঞ্চলে নয়। কর্মজীবীরা বাড়ি থেকে কাজ করতে পারবেন, বাইরে যেতে পারবেন না। প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার কাজেই বাইরে চলাচল করা গেলেও জনসমাগম নিষিদ্ধ। এ জোনের পথ দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারলেও থামতে পারবে না। মসজিদ ও ধর্মীয় স্থানে কেবল খাদেম-কর্মচারীরা থাকতে পারবেন। রোগী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা নমুনা সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত বুথ থাকবে। গ্রামীণ এলাকায় মুদির দোকান ও ফার্মেসি খোলা রাখা গেলেও রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান ও টং দোকান খোলা রাখা যাবে না। তবে হোম ডেলিভারি চলবে।
ইয়েলো জোন : এক লাখে ৩ থেকে ২৯ জন সংক্রমিত হলে সেই এলাকা ইয়েলো জোন। কৃষিকাজ ও ফার্মিংয়ে কাজ করা যাবে। তবে কারখানা-কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে শিফট বৃদ্ধি করে বা ৫০ শতাংশ কর্মী কাজ করবে। ৫০ শতাংশ মানুষকেই বাড়ি থেকেই কাজ করবেন। জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সড়ক পথে তিন চাকার যানবাহনে এক জন যাত্রী ও চার চাকার যানবাহনে ৫০ শতাংশ আসন যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। মুদির দোকান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেও দোকান খোলা থাকবে। রেস্তোরাঁয় টেকআউট সার্ভিস চালু থাকবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদ ধর্মীয় উপাসানালয় চালু থাকবে।
গ্রিন জোন : এক লাখে ৩ জনের নিচে করোনায় আক্রান্ত হলে সেটা গ্রিন জোন। এ জোনে কৃষিকাজ-ফার্মিং এবং কারখানা খোলা থাকবে। ৩০ জনের বেশি মানুষের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস খোলা রাখা, চলাচলে তেমন বিধিনিষেধ থাকছে না। শপিং মল বন্ধ থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন