আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে কয়েক হাজার লোক বিক্ষোভ জানাতে থাকায় বিশ্বের দৃষ্টি দেশটির বর্ণবাদ সমস্যা এবং পুলিশি বর্বরতার দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো ভারতীয় তারকারাও দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই বর্বর হত্যাকান্ডে। তবে, এই ঘটনা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রতিও অস্বস্তিকর প্রশ্নটি উত্থাপন করেছে: ভারতে ঘন ঘন পুলিশি বর্বরতার ঘটনায় গণবিক্ষোভ নেই কেন?
আমেরিকানরা যখন বর্ণবাদ ঠেকাতে তাদের সমাজে বর্ণবাদের ভূমিকা এবং এটি কীভাবে পুলিশি কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে তা খতিয়ে দেখছে, তখন ভারতে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী এবং তাদের দুর্নীতির পেছনের অন্তর্নিহিত কারণগুলি ধর্ম, জাত, ক্ষমতা এবং সম্পদ দ্বারা নির্মিত বৈষম্যসহ আরো জটিল হয়ে উঠছে। ২৫ মার্চ থেকে ভারতের কঠোর করোনা লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে পুলিশের নিরবচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনা প্রকাশিত হয়। মধ্য ভারতের শহর পুনেতে পুলিশ মিথ্যা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালককে গাড়িতে অবৈধভাবে যাত্রী পরিবহনের জন্য মারধর করে।
পশ্চিমবঙ্গে এক ব্যক্তি দুধ কিনতে বেরোনোর সময় পুলিশ তাকে শারীরিক নির্যাতন করে বলে অভিযোগ করা হয়। আহত হয়ে মৃত্যু ঘটে তার। স্থানীয় একটি অলাভজনক সংস্থার একটি প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, দেশটি লকডাউনে যাবার প্রথম সপ্তাহে পুলিশ ১শ’ ৭৭ জনকে লাঞ্ছিত করেছে এবং ২৭ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিহারের পূর্বাঞ্চলে পুলিশ লকডাউনের সময় আলু পরিবহনকারী এক ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুষ চায়। তিনি অস্বীকার করলে পুলিশ তাকে গুলি করে।
মধ্য প্রদেশে পুলিশ এক লোককে তার কপালে ‘আমি লকডাউন লঙ্ঘন করেছি, আমার কাছ থেকে দূরে থাক’ লিখে লকডাউন লঙ্ঘন করার শাস্তি দেয়। পাঞ্জাবের পুলিশ এক লকডাউন অমান্যকারীকে মাটিতে নাক ঘঁষিয়ে শাস্তি দিয়েছে। এই দৃষ্টান্তগুলি দেশের প্রায় লাখ লাখ দিনমজুর, রাজ্যের বাইরে থাকা কর্মী, বাড়িতে থাকার আকস্মিক আদেশে নিরুপায় হয়ে পড়াদের অনেককেই প্রভাবিত করেনি।
বিবিসি অনুসারে, পুলিশ মুসলিম বিক্ষোভকারীদের ওপর পাথর নিক্ষেপ এবং তরুণ মুসলিম পুরুষদের পিটিয়ে হত্যা করার পর দিল্লিতে সরকারের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে এবং বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ সহিংস দাঙ্গায় পরিণত হয়। দাঙ্গার সময় প্রমাণিত বাড়াবাড়ির জন্য কোনো পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়নি।
ভারতের পুলিশ বাহিনীর এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলি অবশ্যই নতুন নয়। গত বছর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন যে, তারা উত্তরপ্রদেশে পুলিশের বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকান্ডের বিষয়ে ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’। যদি পুলিশের জবাবদিহিতার দাবিতে জনগণ বিক্ষোভ না করে, তবে এটি হতে পারে যে, পুলিশ নিজেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকা সমস্যাগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। একটি থানায় উচ্চ বর্ণের, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার জীবনের অভিজ্ঞতা নিপীড়িত নিম্নবণের্র এক দরিদ্র কর্মকর্তার চেয়ে একেবারেই আলাদা।
দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতাতেই ভারতের রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি চলে। পুলিশ বাহিনী তত্ত¡াবধান করেন রাজনৈতিক কার্যনির্বাহী, যার নেতৃত্বে থাকেন রাজ্যগুলির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা। পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ এবং কর্মজীবনের অগ্রগতি সরাসরি রাজনৈতিক নেতাদের তদারকিতে হয় বলে পুলিশ জনগণের কাছে নয়, বরং রাজনীতিবিদদের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকে।
ভারতের তারকা, রাজনীতিবিদ এবং গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক, যারা মার্কিন পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে ক্ষোভের সাথে টুইট করতে পারেন, তারা যখন তাদের নিজের দেশের সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখে প্রতিবাদ করেন না, তখন তাদের কথার ওজন খুব সামান্যই। ভারতীয় জনগণের অনেকের কাছে এর অর্থ হ’ল, গুরুত্বপূর্ণদের নিজস্ব ক্ষমতা এবং বিশেষ সুযোগের অবহেলা করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন