বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চিকিৎসাপ্রার্থীদের অশেষ বিড়ম্বনা

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০২০, ১২:০২ এএম

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ে প্রত্যেক মানুষকে চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়। চিকিৎসা জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদা হলেও চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের হাহাকার আর আর্তনাদ হাওয়ায় ভাসছে। পত্রিকায় একটি রিপোর্ট দেখলাম, বিনা চিকিৎসায় অনাদর-অবহেলায় প্রখ্যাত নজরুল গবেষষক ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সাবেক সহকারী সম্পাদক শেখ দরবার আলম চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এ সংবাদটি দেশের চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে। তবু শেখ দরবার আলমের মেয়ে ফারহানা রহমানের ভাষ্য পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরলাম। বাবাকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হার্ট ফাউন্ডেশন ডাক্তারের পায়ে পর্যন্ত পড়েছি। এরপরও তাদের মন গলাতে পারিনি। হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের সিসিইউ থেকে নির্দয়ভাবে তাকে বের করে দেয়া হয়। হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি করেনি। তাদের কাছে অনেক কাকুতি ও মিনতি করেছি। কিন্তু তাদের পাষাণ হৃদয়ে একটুও মায়া হয়নি। চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার বেদনা শুধু শেখ দরবার আলম পরিবারের- তা কিন্তু নয়! খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরকম হাজারো মানুষ বিনাচিকিৎসায় অকালেই না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম, করোনাকালে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই মানবতাবোধের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। করোনা জাত-পাত, রাজা-বাদশা সরকারি দল, বিরোধীদল কিছুই মানছে না। সাবধানতা অবলম্বন এবং আরশের মালিকের দয়া ব্যতীত এ ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।

চিকিৎসা এক মহান পেশা। এ পেশার কাউকে ছোট কিংবা বড় করা উদ্দেশ্য নয়, চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের কথাগুলো তুলে ধরাই এ নিবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। একজন চিকিৎসকের একটু ভালো ব্যবহারই পারে একজন অসুস্থ রোগীকে সুস্থ করে তুলতে। একজন চিকিৎসক যদি সেবার মনমানসিকতা নিয়ে রোগী দেখেন তাহলে কেবল নীতিবোধই জাগ্রত হবে বিষয়টি এমন নয়, আস্থার জায়গাটি তৈরি হলে তখন মানুষ আর চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডে ছুটবে না। মানুষ খেয়ে না খেয়ে জমি বিক্রি করে চিকিৎসার অর্থ যোগাড় করে। চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে, চিকিৎসার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। এতে সারা বিশ্বে প্রতিবছর কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। অথচ ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার প্রয়াসে। চিকিৎসা অধিকার, কারও দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়! সংবিধান স্বীকৃত এ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। তাহলে কেন মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এখন না হয় করোনাকাল। কিন্তু করোনার আগে কি মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু এত হাহাকার আমরা দেখিনি। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু কিংবা চিকিৎসাবঞ্চিত হওয়ার ঘটনা নতুন তা কিন্তু নয়! নিকট অতীতে রাজধানীর আজিমপুর মাতৃসদনের পরিচালক, চিকিৎসক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সন্তান সম্ভাবা একজন গরিব রোগীর সঙ্গে অমানবিক আচরণের ঘটনাটি পাঠকের মনে থাকার কথা। টাকা না থাকায় ওই নারীর স্থান সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হয়নি। এক অপরিচিত ব্যক্তির সহযোগিতায় ওই নারী আজিমপুর মাতৃসদনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সেখানেও তার ঠাঁই হয়নি। তাঁরা তাকে প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু ওই মহিলা টাকা না থাকার অক্ষমতা যখনই প্রকাশ করল তখনই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রসব বেদনায় ছটফট করা সে প্রসূতি নারীকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। কিন্তু তাকে বেশি দূর যেতে হয়নি। মাতৃসদনের বারান্দাতেই তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। মায়ের পেট থেকে সন্তান বেরিয়ে এলেও সন্তানটি বেঁচে থাকেনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সন্তানের মৃত্যু হয়। এই নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্তই।

আমরা এতদিন উন্নয়নের জোয়ারে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি। ইউরোপ আমেরিকা না পারলেও আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে প্রস্তুত এমন জিগিরের আওয়াজ কর্তাব্যক্তিদের নিকট থেকে শুনেছি। কিন্তু করোনাকালে দেখলাম সবই ফাঁকা বুলি। একটি সহযোগী পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে ‘হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে মারা গেলেন অতিরিক্ত সচিব’। এই খবরটি চোখে আঙুল দিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার কথা বিশ্ববাসীকে জানান দিল। কিডনি জটিলতায় অসুস্থ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচকে যেখানে চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে মরতে হয় সেখানে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে চিকিৎসাসেবা কতটুকু জুটবে তা সহজেই অনুমেয়। শুধু গৌতম আইচই নন, করোনা দুর্যোগকালে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় অনেক রোগীকে রাস্তায়ই মরতে হচ্ছে। অনেকে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যাচ্ছে। অবস্থাটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, করোনা আছে অথবা নেই, তবু সার্টিফিকেট লাগবে। না হয় আপনি যে রোগেই আক্রান্ত হন না কেন হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন না। অথচ উন্নত বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি মারাও যাচ্ছে। তবু প্রতিটি মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। ওইসব দেশের ডাক্তার-নার্সরা জীবন বাজি রেখে রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কোনো জটিল কিংবা সর্দি জ্বরের রোগী ভর্তি করছে না। হাসপাতালের দোরগোড়া থেকেও মুমূর্ষ রোগীদেরকে নির্দয়ভাবে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেক রোগীর জীবন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটিতে ঝরে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন দায়হীন কর্মকান্ড আমাদেরকে ব্যথিতই করে।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি সকল হাসপাতাল চালু আছে। অথচ মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ১০ হাজারের মতো ক্লিনিক আছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার তো মুদী দোকানের মতো। অথচ এই সংকটকালে ওইসব হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেও মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে। পত্রিকার প্রকাশিত খবর মারফত জানতে পারলাম যে, বাত, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি, কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েড, হাম, পোলিও, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দেখা পাচ্ছে না। সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অনেকে চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে যারা অসুস্থতায় ভোগছে তারা চিকিৎসা পাচ্ছে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে ক্যান্সার, কিডনি ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ৪ কোটি মানুষ। এসব রোগে যারা নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় ডায়ালাইসিস করাত তারাও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি সন্তানসম্ভাবা প্রসূতি গাইনি রোগীরাও জরুরি সেবা পাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে ৫-৬ লাখ ক্যান্সারের রোগী রয়েছে। প্রতিবছর ৫০-৬০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে মারা যায়। কিডনি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ২-৩ কোটি মানুষ কিডনি সমস্যার আক্রান্ত। প্রতি বছর ৪০ হাজার রোগীর কিডনি অকার্যকর হয় এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৪ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য মতে, এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। তাদের হিসাব মতে, শতকরা ৮ ভাগ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। উপরোক্ত তথ্যগুলো প্রমাণ করে মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা কত জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা বঞ্চিত রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন