আমাদের দেশে দিন দিন করোনা সংক্রমন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। মৃত্যুর সংখ্যায় বড়রা অনেক এগিয়ে থাকলেও শিশুদের মধ্যেও মৃত্যু বাড়ছে। প্রথম দিকে শিশুদের মধ্যে এটি তেমন একটি সংক্রমিত হবে না বলেই ধরে নেয়া হয়েছিল। তারপরও বৈশ্বিক সংক্রমন শিশুদের মধ্যে ১-২% । আমাদের দেশেও এর কাছাকাছি। কিন্তু সব মিলিয়ে সংক্রমনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারনেই শিশুদের মধ্যেও এর প্রকোপ বেশী দেখা যাচ্ছে।
নতুন করে কিছু খারাপ উপসর্গ শুধুমাত্র শিশুদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা এর নাম দিয়েছে- মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রম ইন চিলড্রেন। লক্ষন বিচারে এটি শিশুদের দূর্লভ রোগ কাওয়াসাকির সাথে কিছুটা মিলে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার পাশাপাশি আমাদের দেশের শিশু বিশেষজ্ঞরা এটি নিয়ে চিন্তিত। সিনিয়র শিশু বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে বলছেন।
এই দূর্লভ কাওয়াসাকি রোগে শরীরের রক্তনালী গুলি বিশেষ করে হার্টের রক্তনালীতে প্রদাহ হয় এবং তা ফুলে চওড়া হয়ে যায়। ফলে হৃদপিন্ড, ফুসফুস, ব্রেন, কিডনি, চোখ, হাত-পা সহ শরীরের প্রায় সব অঙ্গই প্রায় একসাথে আক্রান্ত হয়। শিশুর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। এই রোগটি আগে খুব কম সংখ্যক শিশুর মধ্যেই হত। কিন্তু এখন করোনার পর এর আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় পরীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে বাচ্চাগুলি আসলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরই এমনটা হচ্ছে। তাই ডাক্তাররা একে আর কাওয়াসাকি রোগ বলে মেনে নেননি। এটির নামকরণ হয়েছে- মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রম ইন চিলড্রেন। এর কারনে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মৃত্যু বেড়ে যাচ্ছে।
আপাতত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগ নির্ণয়ের জন্য এর একটি সংগা ঠিক করেছে, আর তা হল-
শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স ০-১৯ বৎসর, তাদের যদি জ্বর থাকে ৩ দিন বা তার বেশী এবং নীচের ৫টা বিষয়ের যে কোন ২টা সাথে থাকে-
১। র্যাশ অথবা পুঁজ ছাড়াই চোখের প্রদাহ বা মুখ-হাত-পায়ের ঝিল্লি-চামড়ায় প্রদাহ।
২। রক্তচাপ খুব কমে যাওয়া বা শকে চলে যাওয়া।
৩। মারাত্মক হৃদরোগ- হৃৎপিন্ডের প্রদাহ, ভাল্বের প্রদাহজনিত সমস্যা-যা ইকোতে দেখা যায়, ট্রপোনিন বেড়ে যাওয়া থেকেও বুঝা যায়।
৪। বিভিন্ন রকমের রক্ত জমাট বাধা ও রক্ত ঝড়ে যাওয়ার সমস্যা।
৫। পেটের সমস্যা-ডায়রিয়া, বমি বা পেটে ব্যথা। এবং
প্রদাহের কারণে রক্তে এর মার্কারগুলি বেড়ে যায়-ইএসআর, সিআরপি, প্রোকেলসিটোনিন। এবং
অন্যকোন জীবাণুর সংক্রমনের কারণে এমনটা হয় নাই তা নিশ্চিত হওয়া। এবং
করোনা সংক্রমিত হওয়ার প্রমান আছে (আরটিপিসিআর পজিটিভ) বা পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসা।
কি লক্ষণ থাকলে এই মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রম হয়েছে বলে সন্দেহ করবেন?
জ্বর
পেট ব্যথা
বমি
ডায়রিয়া
ঘাড় ব্যথা
র্যাশ
চোখ লাল ও প্রদাহ
অতিরিক্ত দূর্বলতা
এই লক্ষণগুলির মধ্যে র্যাশ ও জ্বরই প্রধান । আর কম হয় অন্যান্যগুলি- লাল চোখ, হাত-পা ফুলে যাওয়া ও গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া।
কিভাবে এই রোগটি নির্ণয় করা হয়?
নাকের রস
রক্ত পরীক্ষা
বুকের এক্সরে
ইকো কার্ডিওগ্রাম
পেটের আল্ট্রা সাউন্ড
পিসিআর টেষ্ট পজিটিভ হলে বুঝা যায় এখনই তার ইনফেকশন আছে। এক তৃতীয়াংশের শরীরে এটি পাওয়া যায়। তবে বাকিদের এন্টিবডি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এদের আগেই ইনফেকশন হয়েছিল।
কিভাবে বর্তমানে এর চিকিৎসা হয়ঃ
যে বাচ্চাদের এটি হবে তাদের অবশ্যই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা শুরু করতে হবে এবং তা খুব দ্রুতই শুরু করতে হবে। কারন হৃদপিন্ড এবং অন্যান্য রক্তনালী গুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। তবে কারও কারও আইসিইউ লাগতে পারে।
যেহেতু মারাত্মক হৃদপিন্ডের প্রদাহ থাকে, তাই কাওয়াসাকি রোগের চিকিৎসার মতই এর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। প্লাজমা, স্টেরয়েড, আইভিআইজি এসব দিয়েই চিকিৎসা হচ্ছে। চিকিৎসাও খুব ফলপ্রসু। তবে সারা বিশ্বেই কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
সারা বিশ্বে ২০০ এর মত রুগী সনাক্ত হয়েছে। তাই এখনও চিকিৎসা নিয়ে বেশী কিছু নতুন যোগ করা যায়নি। তবে আইভিআইজি ভাল ফল দিচ্ছে। এটিতে জ্বর এবং প্রদাহ দু’টোই কমছে বলে প্রমান পাওয়া গেছে। চিকিৎসায় ৩-৫ দিনেই এটি ভালোর দিকে যায়।
কাদের মধ্যে এটির তারতম্য কেমন হয়ঃ
০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে যে কারোই এটি হতে পারে, তবে ৭-৮ বছরের মধ্যেই বেশী পাওয়া যাচ্ছে।
কোন এলাকায় কত বেশী বাচ্চা আক্রান্ত হচ্ছে তার উপরও সংক্রমন সংখ্যা নির্ভর করবে।
আবারও সেই সামাজিক দুরত্ব, হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহারের উপর এর সংক্রমনের তারতম্য লক্ষ করা গেছে।
তবে এটি ছোঁয়াচে নয়, কারন যার মধ্যে এটির এন্টিবডি পাওয়া গেছে তারা এটি আর ছড়াতে পারবে না।
কারও আগেই শরীরে কোন রোগ ছিল কিনা তার উপরও এটা বেশী হওয়ার কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নাই।
কেন শিশুরাই এতে আক্রান্ত হচেছ?
চিকিৎসকেরা এখনও এটি নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। তবে ধরে নেয়া যায় যে বাচ্চাদের ইমিউন সিস্টেম বড়দের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তাই তাদের এই সিস্টেমের ভিন্ন আচরনের কারণেই এতগুলো শরীরের অঙ্গ একসাথে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।
সবশেষে আবারও বলি, ঘরে থাকি-সুস্থ থাকি। বাইরে বেরুলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করি। সন্দেহ জনক কিছু ছোঁয়া দিলেই ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি। হাত দিয়ে চোখ-নাক-মুখ এলাকা স্পর্শ না করি। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখি। বড়রা বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখি।
ডা. জহুরুল হক সাগর
ইমেইল: zhsagar@google.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন