এলিট ফোর্স র্যাব কর্তৃক কথিত নিখোঁজ সন্দেহভাজনদের তালিকা প্রকাশের পরই সেই তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। গত ১৯ জুলাই র্যাবের ফেইসবুক পেজে তালিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তালিকাভুক্ত কথিত জঙ্গি সন্দেহভাজনদের হাল-হকিকত বেরিয়ে আসে। বলাবাহুল্য, এসব তালিকাভুক্ত ব্যক্তির বেশীর ভাগই বাড়িতে, জেলে অথবা বিদেশে রয়েছেন বলে জানা যায়। কেউ কেউ প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে পিতা-মাতাকে না জানিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাঝখানে নিখোঁজ সন্দেহভাজন জঙ্গি তালিকায় চলে গিয়েছিলেন। একটি জেলা থেকে তালিকাভুক্ত ২৯ জনের মধ্যে ২৪ জনই বাড়িতে রয়েছেন এবং বাকি ৫ জনের কেউই জঙ্গি সন্দেহ করার মত নয় বলে খোদ পুলিশের পক্ষ থেকেই জানানো হয়েছিল। এহেন বাস্তবতার আলোকে র্যাবের নিখোঁজ সন্দেহভাজনের তালিকায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। ২৬২ জনের নিখোঁজ তালিকা প্রকাশের ৬ দিনের মাথায় গত সোমবার এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। হালনাগাদ তালিকায় স্থান পেয়েছে মাত্র ৬৮ জন। তবে এই তালিকাও যে সন্দেহ বা ত্রুটিমুক্ত নয়, তাও ইতিমধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে। গতকাল গণমাধ্যমে র্যাবের এই হালনাগাদ তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকেও সারাদেশ থেকে ৪০ জনের একটি নিখোঁজ তালিকার তথ্য পাওয়া যায়।
আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের বেআইনী কর্মকা-ের কারণে পুরো বাহিনীর প্রতি জনগণের অনাস্থা ও বিরূপ ধারণা তৈরী হয়েছে। বিশেষত, পুলিশের দলবাজি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, হয়রানিমূলক মামলাবাজি ও গ্রেফতার বাণিজ্য একটি আতঙ্কজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জননিরাপত্তার একটি মূল শর্ত হচ্ছে জনগণকে নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে আস্থাশীল করে তোলা। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, গুপ্তহত্যা, টার্গেট কিলিং বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে জনমনে আতঙ্ক বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদেরকে আইনের আওতায় আনার আগে জনমনের আতঙ্ক দূর করে অর্থনীতির এই ডাউন-টার্ন রোধ করাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মূল দায়িত্ব। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গি দমন অভিযান জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির বদলে উদ্বেগ ও আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলছে। কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে নিখোঁজদের তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সারাদেশে শত শত পরিবার এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরী হয়েছিল তা’ সহজেই অনুমেয়। বিগত বছরে সারাদেশে শত শত মানুষ নানাভাবে নিখোঁজ হয়। এদের বেশীরভাগই সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার মত নয়। র্যাবের প্রথম তালিকার বেশীরভাগই হয়তো কখনো নিখোঁজ বা নিরুদ্দেশ ছিল। জঙ্গি সন্দেহে নিখোঁজদের তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন ছিল। অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের আগেই তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করার কারণেই বিভ্রাট তৈরী হয়েছে। সংশোধিত তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে র্যাব সেই অপবাদ থেকে মুক্ত হল। তবে জরুরী ও দ্রুততার সাথে তালিকাটি সংশোধনের উদ্যোগ ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়।
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কোন দেশই রাতারাতি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের হুমকি বা আশঙ্কা দূর করতে পারছেনা। তবে আইএস’র মত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো দেশের আভ্যন্তরীণ জাতিগত ও রাজনৈতিক বিরোধকে পুঁজি করেই দেশে দেশে জঙ্গিবাদের থাবা বিস্তার করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নানাবিধ অত্যাধুনিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার মত দেশেও যখন সন্ত্রাস-নাশকতা ঠেকানো যাচ্ছেনা; তখন আমাদের মত জনবহুল দরিদ্র দেশে এ ধরনের হুমকি মোকাবেলা করা অনেক বেশী স্পর্শকাতর ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এই মুহূর্তে শুধু দেশের সাধারণ নাগরিকরাই নয়, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও জঙ্গিবাদী হামলার আতঙ্কে রয়েছেন। গতকাল প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা যায়, আগস্টে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার টার্গেট হিসেবে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদেরও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিপূর্বে ১৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ টেলিকনফারেন্সেও সামনের দিনগুলোতে আরো জঙ্গি হামলার গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে বলে জানানো হয়েছিল। গত সপ্তায় ডিএমপি’র পক্ষ থেকেও একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুসারে মন্ত্রীদের উপর যে কোন সময় সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া এসব সতর্ক বার্তা একদিকে সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হলেও পক্ষান্তরে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বাড়তি শঙ্কা তৈরী করছে। বস্তুনিষ্ঠ গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যৌথ বাহিনীর শত শত সদস্য নিয়ে ১০ ঘন্টাব্যাপী চিরুনী অভিযান চালিয়েও দৃশ্যমান কিছু না পাওয়া, অথবা সারাদেশে খোঁজ-খবর নিয়ে সন্দেহভাজন নিখোঁজ জঙ্গিদের তালিকা প্রকাশের পর তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে জঙ্গি দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। এ ধরনের সংশয় ও আস্থাহীনতা জননিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বড় অন্তরায়। এসব বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরো যুক্তিগ্রাহ্য ও সতর্ক কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন