রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে তিন দিনে দুই হাজার মামলার পরও মিটারে চলছে না বেশির ভাগ সিএনজি চালিত অটোরিকশা। থামছে না বেপরোয়া চালকদের ভাড়া নৈরাজ্য। পুলিশ ও বিআরটিএ’র অভিযানে রাস্তায়ও নামছে না অনেক অটোরিকশা। এতে করে মিটারে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পরও বেশির ভাগ অটোরিকশায় মিটার সংযোজন করা হয়নি। যারা মিটার লাগিয়েছেন তারাও মিটারে ভাড়া আদায় করছেন না, বলা হচ্ছে মিটার নষ্ট।
অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্য প্রতিরোধ এবং মিটারে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে বোববার থেকে অভিযানে নামে পুলিশ ও বিআরটিএ। গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেল পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ট্রাফিক পুলিশ। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ অটোরিকশা আটক করে তাতে মিটার আছে কিনা তা যাছাই করছে। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, আশি ভাগ অটোরিকশায় মিটার লাগেনি। মিটার না থাকায় অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। কিছু অটোরিকশাকে আটক করা হয়েছে। কিছু অটোরিকশায় মিটারে আছে এবং অভিযান শুরুর পর তারা মিটারে ভাড়া আদায় করছে এমন প্রমাণও মিলেছে।
জানা যায়, অভিযানের খবর পেয়ে বেশির ভাগ অটোরিকশা রাস্তায় নামছে না। এতে করে যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। নগরীর কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা যায় অলিগলিতে প্রচুর অটোরিকশা আছে, তবে বড় বড় সড়কে অটোরিকশা কম। বিশেষ করে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিতে ট্রাফিক পয়েন্ট এড়িয়ে চলাচল করছে বেশির ভাগ অটোরিকশা। যাত্রীরা পুলিশকে অভিযোগ করেন, চালকেরা কাছের গন্তব্য হলে মিটারে যেতে চান না, শুধুমাত্র দূরের গন্তব্যে মিটারে যেতে চান।
কয়েকজন চালক অভিযোগ করেন পুলিশ মিটারে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু যেসব মালিক অতিরিক্ত জমার টাকা নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কিছু চালকের অভিযোগ যে মিটার লাগানো হয়েছে তার বেশির ভাগ নষ্ট, এতে করে মিটার কাজ করছে না। মিটার নেই এমন কিছু অটোরিকশার চালকের সাথে কথা হয়; তারা বলেন, দুই একদিন পর অভিযান থেমে গেলে সবকিছু আগের মতো চলবে। এখন তারা পুলিশকে এড়িয়ে চলছেন, আর যদি ধরা পড়েন তবে মামলায় জরিমানা দিয়ে ফের রাস্তায় নামবেন বলেও জানান তারা। তাদের যুক্তি মিটারে ভাড়া আদায় করা হলে তাদের পোষাবে না। কারণ গ্যাসের দাম আর মালিকের জমার টাকা দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে তাদের সংসার চালানো কঠিন। সিএনজি স্টেশনগুলোতে চলছে গ্যাসের সংকট। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়েও পর্যাপ্ত গ্যাস মিলছে না। এতে করে দিনের বেশিরভাগ সময় অটোরিকশা বসে থাকছে। এই কারণেও অনেক চালকের আয় কমে গেছে।
মিটারে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে রোববার থেকে যৌথ অভিযানে নামে ট্রাফিক পুলিশ বিআরটিএ। এর মধ্যে প্রথমদিনই ৯৫০টি মামলা ও ৪০টি গাড়ি আটক করা হয়। এরপর সোমবার দ্বিতীয় দিনের অভিযানে ৭৫০টি মামলা ও ৩০টি গাড়ি আটক করা হয়। গতকাল বেলা ২টা পর্যন্ত ২২৫টি মামলা হয়েছে। আর অটোরিকশা আটক করা হয়েছে ৭টি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ উল হাসান বলেন, গত তিন দিনে প্রায় দুই হাজার অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার পর অটোরিকশায় মিটারে ভাড়া আদায় বেড়েছে। যাদের মিটার নেই তারাও মিটার সংযোজন করছে। তিনি বলেন, মিটারে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ে অটোরিকশাচালকদের বাধ্য করা হবে। আইন অমান্য করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের জিম্মি করতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, প্রতিটি অটোরিকশায় মিটার সংযোজন এবং মিটারে ভাড়া আদায় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।
মাসুদ উল হাসান আরও বলেন, শুধুমাত্র যেসব অটোরিকশা মিটারে চালাচ্ছে না সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়, আমরা অভিযানে মেট্রো এলাকায় যেসব গাড়ি চলতে পারবে না সেই গাড়িগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি মিটারে গাড়ি না চালালে পুলিশকে অভিযোগ জানাতে অনুরোধ করে বলেন, প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশার গায়ে আমরা আমাদের কন্ট্রোল রুমের নম্বর, অভিযোগের নম্বর দিয়েছি। যাত্রীরা সেইসব নম্বরে ফোন করে তাদের অভিযোগ জানাতে পারবেন।
গতকাল অভিযানে বিআরটিএ’র পক্ষে ছিলেন উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন, আমরা এখন পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযানে নামলেও নিয়মিত আমাদের উদ্যোগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। তিনি বলেন, যেসব অটোরিকশায় এখনও মিটার সংযোজন করা হয়নি তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিআরটিএতে তাদের জন্য বিশেষ সেল খোলা হয়েছে। চট্টগ্রামে অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্যে যাত্রীরা জিম্মি দীর্ঘ দিন থেকে। মিটারে ভাড়া আদায় করে না চালকেরা। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কয়েক গুণ আদায় করছে তারা। গণপরিবহন সংকটকে পুঁজি করে চালকেরা যাত্রীদের রীতিমত জিম্মি করে রেখেছে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে মিটারে অটোরিকশা চলাচল বাধ্যতামূলক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল সিএমপি। কিন্তু পরবর্তীতে মিটার সংযোজনের সময় এক মাস বাড়িয়ে দেয়। জানানো হয়, ১ ফেব্রæয়ারি থেকে নগরীর রাস্তায় মিটার ছাড়া কোন অটোরিকশা থাকতে পারবে না। এর মাস খানেক পর যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা যায় চট্টগ্রাম মহানগরীতে মিটার ছাড়া চুক্তিতে চলে ৯৮ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা। ৮৭ শতাংশ চালক অতিরিক্ত বকশিস দাবি করে যাত্রীদের কাছে। যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে যায় না কমপক্ষে ৮৫ শতাংশ চালক। মিটার লাগানো ছাড়া চলাচল করছে ৩৩ শতাংশ। ২৮ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশার মিটার থাকে নষ্ট। নগরীর বিভিন্ন স্পটে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
স¤প্রতি সমিতির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটি ‘সিএনজি অটোরিকশা মিটারে চলাচল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ’ কর্মসূচি পরিচালনা করে। নগরীর বহদ্দারহাট, শাহ আমানত ব্রিজ, কালুরঘাট, চকবাজার, লালদীঘি পাড় এলাকায় একদিন সকাল ১০ টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ৩৬২টি অটোরিকশা, ৩৮৪ জন যাত্রী ও ৩৬২ জন চালকের সাথে কথা বলেন ১২ সদস্যের পর্যবেক্ষণ দল। যার আলোকে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে লোকসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। লোকসংখ্যা অনুপাতে এখানে গণপরিবহনের সংখ্যা একেবারেই কম। নগরীর ১২টি রুটে যত সংখ্যক বাস-মিনিবাস থাকার কথা বাস্তবে তা নেই। রুট পারমিট নিয়েও বাস মিনিবাস রাস্তায় চলে না। বিভিন্ন রুটের বাস সকাল বিকাল কারখানা শ্রমিকদের পরিবহন করতে রিজার্ভ ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। এতে করে নগরীর বিভিন্ন রুটে বাস, মিনিবাসে সংকট লেগেই আছে। যাত্রীদের অভিযোগ, এই সংকটকে পুঁজি করে তাদের জিম্মি করে রেখেছে অটোরিকশা চালকরা। চট্টগ্রাম মহানগরী বৈধ অটোরিকশা আছে ১৩ হাজারের মতো। কিন্তু অবৈধ অটোরিকশার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। আবেদিত (এএফআর) লিখে চলছে কয়েক হাজার অটোরিকশা। আদালতের নির্দেশে এধরনের অটোরিকশা চলাচল মাঝে মধ্যে বন্ধ করা হলেও পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে চলছে এসব অটোরিকশা। এছাড়া সরকার সমর্থক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েও রাস্তায় অটোরিকশা চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন