শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কমছে উন্নয়ন বাড়ছে দুর্নীতি

স্থানীয় পর্যায়ের ১১২ প্রতিনিধি সাময়িকভাবে বরখাস্ত বরখাস্ত করলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে তা নয় : ড. তোফায়েল আহমদ

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২০, ১২:০০ এএম

দুই-তৃতীয়াংশ সরকার দলীয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরও দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় উন্নয়ন কর্মকান্ড নিম্নমুখী। তবে জেলা-উপজেলায় দুর্নীতি বাড়ছে আগের চেয়ে। করোনা পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা কর্মসূচির তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং মসজিদের ঈমামের নামের টাকা বিতরণে ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া অনেক জেলা-উপজেলায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করে সব টাকা তুলে নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আবার অনেক জেলায় ডিসি ও ইউএনও’রা জনপ্রতিনিধিদের চাপে কোনো ধরনের সরকারি বিধিমালা প্রয়োগ করতে পারছে না বলেও জানা গেছে। দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে প্রমাণিত হওয়া জেলা প্রশাসকরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের স্থানীয় সরকার বিভাগকে সুপারিশ করেছে। পরে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪(১) ধারা অনুযায়ী তাদের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ইনকিলাবকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে যে সব জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। অনেক জনপ্রতিনিধি জেলে আছেন। দুর্নীতিবাজদের ছাড় দিবে না সরকার।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গত একশ’ দিনে ১১২ জন স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৪ জন ইউপি চেয়ারম্যান, ৭১ জন ইউপি সদস্য, এক জন জেলা পরিষদ সদস্য, ৪ জন পৌর কাউন্সিলর এবং ২ জন উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সরকারের এমন কঠোর পদক্ষেপের সুযোগ নিচ্ছে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনপ্রতিনিধিদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগও উঠেছে।

স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী সব সিদ্ধান্ত পরিষদের মাধ্যমে গৃহীত এবং পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদনের বিধান রয়েছে। তবে এ বিধান না মানায় অনেক ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ও ইউএনওর মধ্যে দ্ব›দ্ব চলছে। ইউএনওরা স্থানীয় এমপিকেই গুরুত্ব দেয়ার কারণে দ্ব›দ্ব বেশি। সে কারণে অনেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন বলেন জানা গেছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ ইনকিলাবকে বলেন, যেখানে ৬০ হাজার জনপ্রতিনিধি সেখানে ১০০/২০০ জনকে বরখাস্ত করলেই যে দুর্নীতি বন্ধ হবে তা নয়। বর্তমানে প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা পর্যন্ত সরকার দলীয় হওয়ায় এক দিকে যেমন উন্নয়নমুলক কাজ কমছে। আবার সরকারি কোষাগারের টাকা নিয়ে লুটপাট ও দুর্নীতি বাড়ছে। তবে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকলে জনপ্রতিনিধিরা এমন দুর্নীতি করতে পারতেন না। আর সরকারি কর্মকর্তা ঘুষ বাণিজ্যের কারণে প্রশাসনিক ভাবে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও স্বার্থান্বেষী মহলের দুর্নীতিতে বেশির ভাগ খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন নিশ্চিতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের নামে সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অঙ্গীকার ও দেশের সকল প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করা হয়েছে চলতি বাজেটে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত ও অমর্যাদাকর পদক্ষেপ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং অনৈতিকতা প্রশ্রয় পেয়েছে আর সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি এই ব্যবস্থা সৎপথে উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে সরকার প্রকারান্তরে দুর্নীতি ও অবৈধতাকে লাইসেন্স দিয়ে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে জনগণকে উৎসাহ দিচ্ছে।

২০০৯ আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যের ভূমিকা বিরোধপূর্ণ নয় বরং সংসদ সদস্য তার নিজ এলাকার স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় উন্নয়নের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মকান্ডে যাতে গতিশীলতা বজায় থাকে তার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য যথাযথ সহযোগিতা করবেন- এটাই কাম্য। উপদেশ দেয়ার মাধ্যমে কোনো সংসদ সদস্যের কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। উপজেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে কোনো কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হলে এর ফলে নানা রকম অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড স্কুল-কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটি, সরকারি টিউবওয়েল, কাবিখা, ভিজিডি ও ভিজিএফ এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন।

বস্তুত সংসদ সদস্যদের পরামর্শ ও আদেশ অনুযায়ী বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এ জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের বিরোধপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৪ মে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বদলগাছী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম খান। এ ঘটনার চার দিন পর গত ১৮ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের থেকে বরখাস্ত করা হয়।

নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে উপজেলার চেয়ারম্যানসহ ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। সকল বরাদ্দে ঘুষ গ্রহণের ঘটনা ওপেন সিক্রেট। এমনকি গরিব মানুষের জন্য সরকারের অতিদরিদ্র কর্মসূচিতেও তিনি ১৫ শতাংশ ঘুষ নেন বলে অভিযোগ আছে।

২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগ দেন হুমায়ুন কবির। ইউএনও হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের প্রশ্রয়ে ঘুষ গ্রহণ, অর্থ আত্মসাতসহ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড ও পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে ব্যাপক সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ আনে শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৯টি ইউনিয়নের সব চেয়ারম্যান।
শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খান ইনকিলাবকে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ন কবির ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ থেকে ১০ শতাংশ হারে, এলজিইডি শাখা থেকে ৫ শতাংশ হারে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছ থেকে ১৮ শতাংশ হারে, প্রতি নামজারিতে দুই হাজার টাকা, পৌরসভার উন্নয়নকাজে ২০ শতাংশ হারে, বালু উত্তোলনে ট্রাকপ্রতি ৫০০ টাকা সরাসরি ঘুষ গ্রহণ করেন। দুইবার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন