শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দেশে দেশে সন্ত্রাস : মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রধান আলোচ্য বিষয়। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া থেকে শুরু হওয়া জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রধান শহরগুলো থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করেছে। এতদিন ভারত-পাকিস্তান সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলেও এখন তা বাংলাদেশেও কালো থাবা বিস্তার করেছে। ইতঃপূর্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জেএমবির উত্থানের পর শায়েখ আব্দুর রহমান, বাংলাভাইসহ এর মেন্টরদের ধরে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদ-ে দ-িত করার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান অনেকটাই রোধ করা গিয়েছিল। অতঃপর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে অবশিষ্ট জঙ্গি তৎপরতা বন্ধে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের পর সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলের দাবি করা হয়েছিল। গত কয়েক বছরে চিত্র পুরোটাই বদলে গেছে। বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের কবলে পতিত হয়েছে। একের পর এক বিদেশী নাগরিক হত্যা, ডিপ্লোম্যাটিক জোন গুলশানের রেস্টুরেন্টে হামলায় ১৭ জন বিদেশী নাগরিকসহ অন্তত ২৪ জনকে হত্যার পর দেশের বৃহত্তম ঈদের জামায়াতের পুলিশ চেকপয়েন্ট সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায়ও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করেছে। এ সপ্তাহে ইউরোপের আরো অন্তত চারটি শহরে অনেকগুলো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। দু-একটি বাদে সব ঘটনায়ই আইএস দায় শিকার করেছে। এ ছাড়া সোমালিয়ায় একটি শান্তিরক্ষী ঘাটিতে আত্মঘাতী হামলায় ১৩ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী আল শাবাব।
গত ১৮ জুলাই থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত জার্মানির বিভিন্ন শহরের শপিংমল, ট্রেন, হাসপাতাল এবং রাস্তায় সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত এবং কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছে। গত দুই দিনে ফ্রান্সের এক গির্জায় ঢুকে এক যাজককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। জাপানের এক প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্রে এক ঘাতকের ছুরিকাঘাতে ১৯ জন নিহত এবং অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। বাগদাদ, মসুল বা কাবুলে গাড়িবোমায় নিহতদের খবর এখন আর তেমন গুরুত্ব পায় না। প্রতিমাসে শত শত মানুষ এসব আত্মঘাতী হামলায় নিহত হচ্ছে। পশ্চিমা শহরগুলোতে একেকটি সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করা হচ্ছে, আরো কিছু নিরস্ত্র মানুষ বিমান হামলায় নিহত হওয়ার পর জঙ্গিরা আরো বেশি বেপরোয়া হামলা করে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সব ব্যবস্থার ওপর নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। এভাবে যে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয়, তা অনেক আগেই পশ্চিমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলেও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। একেকটি জনপদকে ধ্বংস করে, ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করার যুদ্ধনীতি কোনো কাজে লাগেনি। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সাথে সাথে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। পশ্চিমা শহরগুলোতে মুসলমান নাগরিকদের ওপর নির্যাতন ও বিড়ম্বনা চাপিয়ে দিয়ে তাদের চরমপন্থার দিকে ধাবিত হতে বাধ্য করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক মার্কিন ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তা প্যান পিটার ব্যুরেন।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মিডল-ইস্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী মার্কিন লেখক, কনফ্লিক্ট-নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অ্যাকাডেমিশিয়ান এমি জ্যালম্যানের মতে, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার পেছনে রয়েছে মূলত সামাজিক-রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অবিচার। এছাড়া কোনো জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলে আইনগত ও রাজনৈতিক পন্থার চেয়ে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে বেশি ফলপ্রসূ মনে করলে তারা সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে উাহরণ হিসেবে তিরিশের দশকে ইহুদি সন্ত্রাসবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তবায়নে ব্রিটিশ লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলার যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তার উল্লেখ করেন ড. জ্যালম্যান। সম্প্রতি ব্রিটিশ লর্ডসভার সদস্য ব্যারোনেস টঙ্গ মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসন ও দখলদারিত্বকে দায়ী করেছেন। মার্কিন রাজনীতিকরাও মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতিকে দায়ী করেছেন। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করার পরও যখন তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের নতুন নতুন জনপদকে প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে, তখন মানতেই হবে যে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনের গতানুগতিক পুলিশি ব্যবস্থা বিপরীত ফল দিচ্ছে। একটি পরিবারের একজন সদস্য কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে হত্যা বা নির্মমতার শিকার হওয়ার পর পরিবারের অন্য সদস্যরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়ে পড়তে পারে। জায়নবাদের গোপন এজেন্ডায় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে মূলত এভাবেই বিশ্বে মুসলিম জঙ্গিবাদের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। স্থান-কাল ভেদে সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কাজে লাগাচ্ছে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদীরা। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান অথবা বাংলাদেশÑসর্বত্রই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জনগণের মধ্যে বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ রুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবাদের পথ সুগম করা হয়েছে। মূল সমস্যা এড়িয়ে শুধু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সকলকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন