বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করজে হাসানা

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০২০, ১২:০২ এএম

করোনা গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা বন্ধ প্রায়। ঘরবন্দি অধিকাংশ মানুষ। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে নাম লেখাচ্ছে কতশত মানুষ। এ এক অসম যুদ্ধ। যে যুদ্ধে ইতোমধ্যে নাম লিখিয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশে এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া খুবই কঠিন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, অসচেতনতা, অবহেলা, দুর্নীতি এবং সিদ্ধান্তহীনতা এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে গোটা জাতিকে। এসবের কুপ্রভাব অনিশ্চয়তায় ফেলে দিবে গোটা জীবন ব্যবস্থাকে। তার মধ্যে প্রধান নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনৈতিক জীবনে। ইতোমধ্যে আমরা তা আঁচ করতে পেরেছি। দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাস্তায় ভিক্ষুক কিংবা সাহায্যপ্রার্থীদের সংখ্যা দেখলে তা অনুমান করতে মোটেও কঠিন নয়।

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কলাকৌশল বাতলিয়ে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণেও তাই ইসলামের রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাপনা। ইসলামি অর্থনীতির একটি মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা সমাজের ধনী-গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরি করে। সেখানে চরম দারিদ্র্যের যেমন কোনো ঠাই নেই, তেমনি অসহায়, ক্ষুধার্ত, সাহায্যপ্রার্থী মানুষ সমাজে থাকাকালীন উচ্চ-ধনীরও স্থান নেই। কারণ, ধনীদের সম্পত্তিতে গরিব ও অসহায়দের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে যাতে গরিবরাও তাদের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই ধনিদের সম্পত্তিতে রয়েছে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১: ১৯) এ অধিকার আরো কিছু উপায়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে জাকাত, উশর, সাদাকাহ, করজে হাসানাহ ইত্যাদি

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা তিন শ্রেণির মানুষকে দেখতে পাচ্ছি যাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন।

(১) সত্যিকারের গরিব ও মিসকিন। যারা পূর্বেই অতি গরিব ও নিঃস্ব ছিল এবং এখনও আছে। তারা আগেও অন্যের সাহায্য নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো এবং এখনও তাই করতে হচ্ছে। এ শ্রেণির মানুষের আত্মমর্যাদায় যেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, তেমনি সাহায্য প্রার্থনা এবং জীবন নির্বাহে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই। ফলে, আগের মতোই তাদের জীবন পরিচালিত হচ্ছে। অনেকাংশে এই পরিস্থিতি হয়ত তাদের জন্যে বেশ সুবিধারও। কারণ, এ সময় সমাজের স্বচ্ছলরা তাদের প্রতি একটু বেশিই দয়াপরাবশ হচ্ছে বলে মনে হয়। অন্ততঃ আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে। তাদের জন্যে ইসলাম জাকাত, উশর, সাদাকাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে।

(২) করোনা পরিস্থিতির কারণে একেবারেই অস্বচ্ছল হয়ে পড়েছে এবং অন্যের সাহায্য ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। করোনা পরিস্থিতির পূর্বে হয়ত কোনো ক্রমে শ্রম দিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। এখন সেসব উপায় না থকার কারণে অন্যের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে হাত পাততে কুণ্ঠা করছে না। এমনকি করোনা পরবর্তীতে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেও সময় লাগবে। তাদের জন্যেই ইসলাম ঐ একই ব্যবস্থা করেছে।

(৩) মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্ত কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হচ্ছে। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদেরকে পূর্বের দুই শ্রেণির মতো অবস্থায় পতিত হতে হয়েছে। তাদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে কিছু অর্থনৈতিক সাহায্য সাময়িকভাবে হলেও তারা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারে। তাদের আত্মমর্যাদা যেমন আছে, তেমনি তাদেরকে সাময়িক সহযোগিতা করলে নিকট ভবিষ্যতে সেসব ফেরত দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদভিত্তিক বিভিন্ন ঋণ একটা উপায় মনে করে বলেই এ সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সরব পদাচরণা আমরা একটু বেশিই লক্ষ করছি। কিন্তু ইসলাম তো সুদকে হারাম (নিষিদ্ধ) করে দিয়েছে। তাছাড়া, সুদি ব্যবস্থায় কিংবা সুদভিত্তিক ঋণ প্রকৃত অর্থে কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠানকে কখনোই সুফল এনে দিতে পারে না, বরং তা কারেন্ট জালের মতো আরো অন্যান্য পরিস্থিতির সাথে ঋণগ্রহীতাকে জড়িয়ে ফেলে। সুতরাং তা থেকে মুক্তি পাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে; প্রকারান্তরে অসম্ভবও বটে।

ইসলাম এই সুদকে শুধু হারাম (নিষিদ্ধ) করেই কি চুপ থেকেছেন? এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি? হ্যাঁ, অবশ্যই করেছেন। ইসলামের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কোনো কিছুকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তার বিকল্প হালাল (বৈধ) উপায় নির্ধারণ করে দেয়। ঠিক একইভাবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপরোল্লেখিত তৃতীয় শ্রেণির জনগোষ্ঠির জন্যে করজে হাসানা (উত্তম ঋণ)-এর বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। আল্লাহতা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, আল্লাহকে করজে হাসানাহ দিতে প্রস্তুত। তাহা হইলে আল্লাহ তাহাকে কয়েক গুণ বেশি ফিরাইয়া দেবেন। হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই আল্লাহর হাতে নিহিত।...’ (সূরা আল-বাকারাহ, ২: ২৪৫) এ ছাড়াও সূরা আল-মায়িদার ১২ নম্বর, সূরা আল-হাদিদের ১১ এবং ১৮ নম্বর, সূরা আত-তাগাবুনের ১৭ নম্বর এবং সূরা আল-মুজাম্মিলের ২০ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে স্ববিস্তার আলোচনা করা হয়েছে। সেসব আয়াত পর্যালোচনা করলে যা পওয়া যায় তা হলো: করজে হাসানা সুদবিহীন এমন ঋণ, যা স্বচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ হতে ঋণগ্রহীতা তার সাময়িক অর্থনৈতিক অসুবিধা কাটিয়ে উঠার জন্যে নেবে। এখানে দুইটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। (১) এটি সুদবিহীন এবং সাময়িক অসুবিধা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে এবং (২) স্বচ্ছল ব্যক্তিরাই এটি অস্বচ্ছল বা ঋণপ্রার্থীকে দেবে।

তবে, শর্ত হলো (১) ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করার অভিপ্রায়ে এটি গ্রহণ করবে এবং (২) ঋণদাতা এর বিনিময়ে অতিরিক্ত কোনো সুবিধাই গ্রহীতার কাছ থেকে নেবে না। এ দুইটির কোনটিতে ব্যত্যয় ঘটলে শরয়ী যে উদ্দেশ্য এ ক্ষেত্রে আছে তা ব্যহত হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণে তাই আমাদের স্বচ্ছলদের উচিত করজে হাসানা দেবার অভ্যাস গড়ে তোলা। যদিও এটি আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নেই। এমনকি অধিকাংশ মানুষই এ ব্যাপারে অবহিত নয়। অথচ এটি এমন এক চমৎকার ব্যবস্থা, যা উভয় পক্ষের জন্যেই কল্যাণজনক। সেখানে, ঋণ গ্রহীতার যেমন সম্মানহানীর কোনো সম্ভাবনা নেই উপরোন্তু তার আশু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তেমনি ঋণ দাতারও সাদাকাহের মতো একেবারেই অর্থ কিংবা সম্পত্তি হস্তান্তর হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রতিদান অনেক। আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থব্যবস্থা বুঝার এবং সে অনুযায়ী পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২০ জুন, ২০২০, ১১:৪৬ এএম says : 0
Our country is ruled by ....................... as such they only know how loot our hard earned tax payers money and send this money to other country. Also in order to stay in power they used security force to torture those who speck the corruptions of the Governments. In our country Riba is pandemic, mr yunus also spread Riba in every village in Bangladesh. Riba is such a crime According to Sunan Ibn Majah, Prophet Muhammad [SAW] declared the practice of riba worse than "a man committing zina (fornication) with his own mother". In that hadeeth, he said that there are 70 sins of riba
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন