ঢাকার জুরাইনে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় দুই রুমের এক বাসায় ভাড়া থাকতেন সাদেক আলী। জুরাইন বাজারে ক্রোকারিজের ব্যবসা করে দুই সন্তান নিয়ে ভালই চলছিল তার সংসার। করোনার কারণে প্রায় তিন মাস ধরে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। এ কারণে স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দুই রুমের বাসা ছেড়ে উঠেছেন মেসে। মোহাম্মদপুরে ৬ তলা বাড়ির মালিক সোহরাব হাসান জানান, গত তিন মাস ধরে তার বাড়ির ভাড়াটিয়ারা চলে যাচ্ছে। চলতি মাসেও গেছে দুই জন। ১৫টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৬টি ফাঁকা। আয় রোজগার কমে যাওয়ায় ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে দিচ্ছে বলে জানান তিনি। মিরপুর ১০ নম্বর সেক্টরের বাড়ির মালিক আশরাফ হোসেন জানান, মিরপুরে তাদের ৬টি বাড়ি রয়েছে। বহুতল বাড়িগুলোতে এখন বেশিরভাগ ফ্ল্যাটই খালি। ভাড়াটিয়াদের মধ্যে অনেকেই চলে গেছেন। কেউ আগামী মাসে যাবেন। কেউবা যাবেন ঈদুল আযহার আগে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার বাসিন্দা আলী হোসেন জানান, তার ৫ তলা বাড়ির ৮জন ভাড়াটিয়ার মধ্যে ৪জনই বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। দুই মাস ধরে টু-লেট ঝুলিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ভাড়ার জন্য কেউ আসছে না। পুরান ঢাকার প্রায় সব বাড়িতেই একইরকমভাবে টু-লেট ঝুলছে বলে জানান তিনি। শুধু পুরান ঢাকা নয়, রাজধানীর সব এলাকাতেই এখন বাসায় বাসায় ঝুলছে টু-লেট সাইনবোর্ড। গত কয়েক দিনে রাজধানীর খিলগাঁও, মানিকনগর, তালতলা, মুগদা, বাসাবো, রামপুরা, বনশ্রী, জুরাইন, মুরাদপুর, দনিয়া, শনিরআখড়া, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরখান, দক্ষিণ খান, পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, নয়াটোলা, বাবুবাজার, শাঁখারীপট্টি, মীরহাজিরবাগ, সুত্রাপুর, বাড্ডা, গুলশান, বনানী, ডেমরা, রায়েরবাগ, ধানমন্ডি, কলাবাগান এবং কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় খোঁজ নিয়ে বহু বাড়িতে টু-লেট সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবিকার চাহিদায় প্রতিদিনিই মানুষ রাজধানীতে আসে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণা থাকায় মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে। এতে করে তারা প্রাত্যহিক খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু পর ৬৬ দিন সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ছিল। সেসময় বন্ধ ছিল কলকারখানা, সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোর নির্দেশনার কারণে অচল হয়ে পড়েছিল অর্থনীতির চাকা যা এখনো পুরোপুরি সচল হয়নি। দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় বেতনের চাকুরে সবার জীবনেই কোনো না কোনোভাবে এর প্রভাব পড়েছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছে। আবার ছেলেমেয়ের স্কুল কলেজ বন্ধ। সে কারণে যারা চাকরি হারিয়েছে তারা একদিকে সংসারে বোঝো টানতে পারছে না। আয় কমে যাওয়ায় বাসা ভাড়া একটা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য অনেকেই নিজে মেসে উঠে পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, এ রকম চলতে থাকলে ঢাকা ফাঁকা হয়ে যাবে। আমার মতে, করোনা পরিস্থিতিতে বাসা বাড়ির ভাড়া এবং বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের দাম কমানো উচিত। তাহলে মানুষ কষ্ট করে হলেও টিকে থাকতে পারতো।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর মতে, চলমান করনোভাইরাস মহামারিতে দেশের ১ কোটি ৩ লাখ মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষ করে অস্থায়ী কিংবা খন্ডকালীন কর্মসংস্থানে নিয়োজিত নাগরিকরা এ ঝুঁকিতে পড়েছেন। ২০১৬-১৭ শ্রমশক্তি জরিপের উপাত্ত পর্যালোচনা করে এ প্রাক্কলন করা হয়। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিলে কর্ম হারানোর ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
১৪৬৩ বর্গকিলোমিটারের রাজধানীতে বাস করে প্রায় ২ কোটি মানুষ। এর মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ভাড়া থাকে। বেসরকারি এক জরিপ থেকে জানা যায়, ২৭ ভাগ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ ভাগ ভাড়াটিয়া প্রায় অর্ধেক, ১২ ভাগ আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়ি ভাড়া খাতে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষা মতে, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪শ’ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২শ’ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। এ কারণে মানুষকে উচ্চ ভাড়ায়, বলতে গেলে বেতনের বা আয়ের সিংহভাগ টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। বাসা ভাড়ার খরচ মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে। আয় কমে যাওয়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। এব কারণে রাজধানী ঢাকার এখন প্রায় সব এলাকার বাসায় বাসায় ঝুলছে ‘টু-লেট’।
করোনার সংক্রমণ শুরুর দিকে ভাড়াটিয়াদের পক্ষে বাসা ভাড়া মওকুফের দাবি উঠেছিল। অনেকেই সে সময় বাসা ভাড়া মওকুফ করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বাড়ির মালিকদের মহানুভবতার মূল্যায়ণ করেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বাড়িওয়ালাদের পক্ষ থেকে হাউজিং ট্যাক্স কমানোর দাবি তোলা হলেও তাতে সাড়া মেলেনি বলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাড়িওয়ালারা জানিয়েছেন। টিকাটুলি এলাকার বাড়িওয়ালা হারিছ উদ্দিন বলেন, আমি মার্চ মাসে কোনো ভাড়াই নেইনি। মে মাসে ঈদ উপলক্ষে অর্ধেক ভাড়া নিয়েছি। এ মাসে হাউজিং ট্যাক্সের টাকা জমা দিতে হবে। সুতরাং আর কমাতে পারবো না বলে ভাড়াটিয়াদের জানিয়ে দিয়েছি। ইতোমধ্যে দুজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আরও একজন সামনের মাসে চলে যাবেন। এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অনেকেরই আয় কমেছে। এই অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করা অনেকেরই জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি- নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করার জন্য, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছেন না। অনেক মানুষ বেকার এবং আয় কমে যাওয়ার কারনে তাদের পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আয়ের আশায় সে নিজে কোন একটি মেসে বা কম টাকা ভাড়ার বাসায় উঠেছে। তিনি বলেন, বাসা মালিকরা ভাড়াটিয়াদের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে ভাড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। যে কারণেও অনেকেই বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে বাড়ির মালিকদের উচিত কিছুটা ছাড়, কিছুটা ভাড়া মওকুফ করা।
এদিকে, প্রতিদিনই মহাসড়কে দেখা যাচ্ছে মালামাল ভর্তি ট্রাক বা মিনি ট্রাক ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ ট্রাক স্ট্যান্ডের মালিক সমিতির নেতা রুস্তম আলী বলেন, বাসা বাড়ির মালামালের জন্য এখন ট্রাক বা মিনি ট্রাক, পিকাপভ্যান বেশি ভাড়া হচ্ছে। মানুষ বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় যানজট নেই বলে আগের তুলনায় ভাড়া কমই নেয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন