স্টাফ রিপোর্টার : বিশ্বব্যাপী বেড়েছে হেপাটাইটিস রোগের বিস্তার। প্রতিদিন বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ৪ হাজারের বেশি লোক। শুধু বাংলাদেশেই হেপাটাইটিস সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস প্রাতিরোধে ভ্যাক্সিন থাকলেও সি ভাইরাসের কোনো ভ্যাক্সিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিচ্ছন্ন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ, অপরীক্ষিত রক্তগ্রহণ ও অসচেতনতার কারণে বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস রোগের বিস্তার ঘটছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়Ñহেপাটাইটিস ভাইরাসের ধরনগুলোকে এ, বি, সি এবং ই হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার সিরোসিস হয়ে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, মানবজাতির একটি প্রধান রোগ হিসেবে বিবেচিত হেপাটাইটিস ‘বি’। পৃথিবীতে ২০ কোটি লোক এ ভাইরাস সংক্রমণের শিকার। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণের শিকার আনুমানিক ৩৫ কোটি লোক। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হেপাটাইটিস বি ও সি’র সংক্রমণে প্রতিবছর প্রাণ হারায় ১০ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। ৫০০ মিলিয়ন লোক ক্রনিক ভাইরাল সংক্রমণের শিকার।
বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের তথ্য মতে, বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। এ হার প্রতি ১২ জনে একজন। বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। হেপাটাইটিসের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ২০০৮ সালে বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স বিশ্ববাসীকে সচেতন করার জন্য এগিয়ে আসে এবং বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করছে। দেশে গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রন্ত। এর মধ্যে যাদের শরীরে ই-এন্টিজেন পজিটিভ রয়েছে, তাদের নবজাতকের শরীরে এ ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হেপাটাইটিসের চিত্র ভয়াবহ। অ্যাসোসিয়েশন ফর দি স্টাডি অব লিভারের তথ্যমতে, দেশে শতকরা ৫ থেকে ৬ ভাগ মানুষ বি ভাইরাসে আক্রান্ত। আর কমপক্ষে ১ ভাগ মানুষ সি ভাইরাসে আক্রান্ত। সেই হিসেবে দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। সুপ্ত অবস্থায় আছে ১২ লাখ লোকের ভেতর। হেপাটাইটিসে লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন মদ্যপান ও স্থূলতার কারণে যকৃতে চর্বি জমাসহ বিভিন্ন কারণে লিভারে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত রোগী থেকে সুস্থ মানুষের শরীরে রক্তগ্রহণ ও সিরিঞ্জ, দৈহিক মিলন ও ক্ষুর বা বেøড ব্যবহারের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায়। এছাড়া আক্রান্ত মা থেকে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত তাদের ২০ শতাংশ। এছাড়া ৫ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে লিভার সিরোসিসে মৃত্যুবরণ করে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং এইচআইভির চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক। ‘বি’ ভাইরাসটি সংক্রমিত ব্যক্তির সব দেহ তরলে, যেমন রক্ত, বীর্য, ঘাম, অশ্রæ, এমনকি বুকের দুধেও পাওয়া যায়। অনেক সংক্রমিত ব্যক্তির কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে যাদের থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের উপসর্গ লক্ষ করা যায় বমি হওয়া, ক্লান্তি লাগা, জন্ডিস, পেটে ব্যথা, তরল মল, হাড়ের গিঁটে ব্যথা ইত্যাদি।
এদিকে ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই লিভার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। ক্রনিক হেপাটাইটিস লিভারসিরোসিস তৈরি করে। এর কিছুদিন পর লিভার সিরোসিস সংক্রান্ত জটিল রোগ থেকে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাস ‘বি’ ভাইরাসের মতো করেই শরীরে প্রবেশ করে। হেপাটাইটিস ‘সি’ প্রধানত রক্ত থেকে রক্তে সংক্রমণ ঘটে, ‘বি’ ভাইরাসের মতোই। উপসর্গের মধ্যে আছে বমি, ক্লান্তি, পেশি ও গিঁটে ব্যথা, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা, মনোযোগের অভাব, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস এইচআইভি এইডসের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক। বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ লোক এইডসে মৃত্যুবরণ করে তার চেয়ে অনেক বেশি হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তিনি বলেন, বি ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন রয়েছে। তবে বি ভাইরাস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। অন্যদিকে সি ভাইরাসের কোনো ভ্যাক্সিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু সি ভাইরাসের চিকিৎসা রয়েছে। উন্নত বিশ্বে এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ইউরোপের দেশগুলোতে সি ভাইরাস চিকিৎসায় প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু বাংলাদেশ মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকায় এই রোগ নিরাময় সম্ভব।
দিবসটির এবারে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ হয়েছে ‘নো হেপা-২০৩০’ যার বাংলা করা হয়েছে ২০৩০-এর মধ্যে হেপাটাইটস আর নয়। দিবসটি উপলক্ষে বিএসএমএমইউ’র হেপাটোলজি বিভাগ, অ্যাসোসিয়েশন ফর দি স্টাডি অব লিভার, ভাইরাল হেপাটাইটিস ফাউন্ডেশন শোভাযাত্রা, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন