শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

স্মার্ট ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা

আবু সালেহ মোহাম্মদ সায়েম | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরই বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় তিন মাস ধরে শিশু, কিশোর, তরুণরা গৃহবন্দি হয়ে আছে। চার দেয়ালের মধ্যেই চলছে তাদের খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, বিনোদন, কাটছে সময়, কাটছে দিন-রাত। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলিত জীবনের বাইরে একটি নতুন জীবন পেয়েছে, হোমওয়ার্ক নেই, ঘণ্টা ধরে পড়ার কোনো নিয়ম নেই, শিক্ষকের শাসন নেই। নতুন একটি জীবন। মুক্ত, স্বাধীন। সে জীবনে, পড়ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। লেখাপড়ায়ও মনোযোগ নেই আগের মতো। কিন্তু সময় পার করার জন্য কী করবে তারা? বেছে নিয়েছে টিভি আর স্মার্ট ডিভাইস।

অনেক অভিভাবক করোনাকালীন এই সময়ে তাদের সন্তানদের সাথে লুডু, দাবা, ক্যারাম খেলে সময় কাটালেও, শিক্ষার্থীরা এসব খেলার চাইতে ডিভাইসের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ধরনের বইয়ের প্রতি অভিভাবক, তাদের সন্তানদের আকৃষ্ট করতে চাইলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে অনলাইনে সময় কাটানো, ভিডিও দেখা, গেম খেলা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

স্বল্প পরিসরের সময় কাটানোর এসব উপাদান ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব স্মার্ট ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ক্ষতি যেমন চোখ, কান, পেটসহ বিভিন্ন রোগে তারা আক্রান্ত হবে। আচার ব্যবহারেও আসবে পরিবর্তন। স্বাভাবিক স্বভাবটা বদলে যাবে, খিটখিটে স্বভাবে পরিবর্তন হবে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়বে তা হলো, মস্তিষ্কের সমস্যা। প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে যেমন পুষ্টি দরকার, তেমনি মস্তিষ্কেরও পুষ্টি দরকার হয়। মস্তিষ্কের পুষ্টি হলো ভালো চিন্তা। সারাদিন ফেসবুক-ইউটিউবে থাকলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। চিন্তায় পরিবর্তন আসে। ভালো চিন্তা বাদ দিয়ে খারাপ চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়। আচরণ পালটে যায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারও খারাপ হতে থাকে। অনেকের রুটিন পরিবর্তন হয়ে যায়, সারারাত অনলাইনে থেকে দিনের বেলা ঘুমায়। অনেকেই নিজের রুমে একান্তে সময় কাটাতে পছন্দ করে। নিজের রুমে অন্য কাউকে পছন্দ করে না। নিজের রুমের বাইরে বেশি সময় দিচ্ছে না। যেখানে পরিবারের সকল সদস্যেদের সাথে সময় কাটানোর কথা সেখানে দরজা বন্ধ করে, ডিভাইসে ডুব দিচ্ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো ভিডিও গেমস বা পর্নোগ্রাফির প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ছে অনেকেই। অনলাইনে ভিডিও গেমসের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে পড়ছে। দিন দিন বই পড়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চালুর নির্দেশনা দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেছে। অনলাইনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৬টি পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল ক্লাস শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ইউটিউব লাইভ, ফেসবুক লাইভ, গুগল ক্লাসরুম, মাইক্রোসফট টিম, জুম এবং কোর্সেরা পদ্ধতিতে ক্লাস কার্যক্রম চলছে। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্লাসের লেকচার শিট আপলোড করা যায়, সেখানেও শিক্ষার্থীদের বাসার কাজ দেওয়া যায়। অ্যাসইনমেন্টের জন্য গুগুল ফরম, গুগল ডক, গুগল ড্রাইভ ও ইউটিউব ভিডিও যুক্ত করার সুযোগ আছে। ক্লাসরুম থেকে যাওয়ার পর ক্লাসের ভিডিওগুলো পরেও নেয়ার ব্যবস্থা আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে বাংলাদেশ সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে রেকর্ডিং করা ক্লাস প্রচার শুরু করেছে। অনলাইনে ভার্চুয়াল ক্লাস কার্যক্রম প্রশংসনীয় হলেও, দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী এই কার্যক্রমের বাইরে। যাদের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস নেই তাদের জন্য ৩৩৩৬ কল সেন্টারের মাধ্যমে (টোল ফ্রি নম্বর) শিক্ষা সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এত ব্যবস্থা নেয়ার পরেও প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের কতটি পরিবার তাদের সন্তানের জন্য স্মার্ট ডিভাইস পরিচালনায় সক্ষম হবে? দেশের প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কাজ-কর্ম বন্ধ, অফিস-আদালত সকল কিছুই বন্ধ। উপার্জনক্ষম সদস্যদের আয়ের উৎস বন্ধ। উল্লেখ না করলেই নয়, দেশের একটি বৃহৎ অংশই মধ্যবিত্ত, যাদের আয় বন্ধ হলে, হয়তো তিন বেলা রান্না হবে না। কাউকে হেয় বা ছোট করার জন্য বলছি না, যেখানে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে দেশের একটি বিশেষ শ্রেণিকে হোচট খেতে হয়, সেখানে তারা তাদের সন্তানদের কীভাবে একটি স্মার্ট ডিভাইস কিনে দেবে বা স্মার্ট ডিভাইসটি পরিচালনার ব্যয় বহন করবে?

চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন। অন্যদিকে সারাদেশে প্রায় ১৩ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণে নিবন্ধন করেছেন। ৯টি সাধারণ, একটি মাদরাসা এবং একটি কারিগরি মিলিয়ে মোট ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও, করোনার কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হওয়ায় মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিকে দেশের প্রায় ৩৪ লক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষৎ এখন অনিশ্চিত। একাদশে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি অবস্থায় আনন্দে আত্মহারা, অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার তারিখ অনিশ্চয়তার কারণে লেখাপড়া ছেড়েই দিয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতেই তারা স্মার্ট ডিভাইসটি হাতে নেয়ার চেষ্টা করছে। যাদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস ছিল না ইতোমধ্যে অভিভাবকদের অনলাইন ক্লাসের কথা বলে স্মার্ট ডিভাইস সংগ্রহ করেছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যাদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস রয়েছে, তাদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজস্ব একাউন্ট রয়েছে। তাদের ইন্টারনেট একটিভ রয়েছে। সুযোগ পেলেই ঘুরে আসছে অনলাইনের অজানা ভুবন থেকে। যারা অনলাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় থাকছে, তারা নিজেরাই তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে, বলার অপেক্ষা রাখে না। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীদের বিচার বিবেচনা এখনো পাকাপোক্ত হয়নি, তারা নিজেদের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। তাই স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের সময় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, নতুবা আপনার সন্তান, আপনার সামনেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লেখক: প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন