শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পর্দানশিন ছাত্রী গ্রেফতারে আরো সতর্ক হতে হবে

প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জঙ্গিবাদী নাশকতা প্রতিরোধের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থী এবং পর্দানশিন ছাত্রীরা সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশি বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস এখন আমাদের জন্য একটি বড় ধরনের উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার পরও জঙ্গিবাদ দমনের নামে চলছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বহুবিধ তৎপরতা। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সাধারণ মানুষ এসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য। তবে এসব নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা যেন দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত না করেÑঅভিযান পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সে বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান, সন্দেহভাজনদের তালিকা প্রণয়ন যথাযথ ও নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে হচ্ছে কিনা তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েছে। র‌্যাব কর্তৃক ২৬২ জন সন্দেহভাজনের নিখোঁজ তালিকা প্রকাশের পর প্রকাশিত তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পর নতুন তালিকা প্রকাশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত সদস্য নিয়ে ১০-১২ ঘণ্টার চিরুনি অভিযান চালানোর পর মাত্র কয়েরকটি ছুরি-চাপাতি উদ্ধার হওয়ার মতো ঘটনা জঙ্গিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে জনমনে একপ্রকার আস্থাহীনতা তৈরি করছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কয়েকদিন আগে রাজধানীর ইডেন কলেজের একটি হোস্টেল থেকে কয়েকজন ধর্মপরায়ণ পর্দানশিন ছাত্রীকে পুলিশ আটক করার পর গত বুধবার কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের একটি ছাত্রী হোস্টেলে অভিযান চালিয়ে তিন ছাত্রীকে কথিত জিহাদি বইসহ আটক করেছে পুলিশ। তারা ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কর্মী এবং নাশকতামূলক পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিল বলে পুলিশ সন্দেহ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস মাথাচাড়া দেয়ার অনেক আগে থেকেই গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময়ে পর্দানশিন নারীদের পুলিশি নিগ্রহের শিকার হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দেশে চলমান জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে মূলত মেসে ও হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থী ও পর্দানশিন মেয়েদের সন্দেহজনকভাবে আটক হওয়ার ঘটনাগুলো সমাজে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গ্রাম থেকে আগত দরিদ্র শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে বা মেসে থেকে লেখাপড়া করার পর পরিবারের হাল ধরার তাদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আমাদের দেশে রয়েছে। অথচ বর্তমানের জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে তারাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হিজাবধারী বা পর্দানশিন মেয়েরা পরবর্তীকালে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও আমাদের সমাজবাস্তবতায় তাদের নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সারাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া হাজার হাজার মেয়ে, যারা ছাত্রী হোস্টেলে বা মেসে থেকে পড়ালেখা করছে, তাদের অভিভাবকরা এখন চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়েছেন। বিশেষত নামাজি ও পর্দানশিন মেয়েদের অভিভাবকরা বাড়তি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন। তাদের এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ পুরো সমাজেই নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, দেশে চলমান জঙ্গি আতঙ্ক এবং জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার কারণে অন্তত ৫ লাখ শিক্ষার্থী বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। বিশেষত যে সব শিক্ষার্থী পার্টটাইম জব করে সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করে পড়াশোনার খরচ নির্বাহ করে, যেসব শিক্ষার্থী নামাজি-ধর্মানুরাগী, যেসব ছাত্রী হিজাব-বোরকা পরে, তাদের অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। হোস্টেল ও মেসে থাকার ব্যাপারে কড়াকড়ি এবং পর্দানশিন মেয়েদের বাড়তি বিড়ম্বনা নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা এবং কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হওয়ার তালিকাসহ প্রায় বেশিরভাগই শহরের অভিজাত এলাকার ধনী পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে মেসে বসবাসকারী এবং পর্দানশিন ছাত্রীরা ছিল, এমন তথ্য জানা নেই। এমনিতেই জঙ্গিবাদ ও জননিরাপত্তা ইস্যুতে দেশের বিনিয়োগ, রফতানি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা- বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এখন জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও সন্দেহবশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, রেস্টুরেন্ট ও বাড়ির মালিকরা বিড়ম্বনার শিকার হলে তা সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস এখন বৈশ্বিক সমস্যা। পশ্চিমা দুনিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও যেখানে রাতারাতি এ থেকে মুক্তির সহজ কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে জঙ্গি দমনের নামে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচালিত অভিযান ও নানাবিধ তৎপরতায় দেশের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট যেন বেড়ে না যায়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। জঙ্গিদের মদদদাতারা হয়তো বাংলাদেশের শিক্ষা-সামাজিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে চায়। জঙ্গি দমনের নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জঙ্গিদের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হোক, এমনটা দেশবাসীর কাম্য নয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান ও গ্রেফতারে কারো ভিন্ন মত নেই। তবে পর্দানশিন ছাত্রীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলাকে আরো শক্ত ও সচেতন হতে হবে। দেশে নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটছে দ্রুত। এ ধরনের গ্রেফতার, ভয়ভীতি ও শঙ্কার কারণে তা যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন