মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অধিক গুরুত্ব বহন করে। প্রতিটি মানুষের সঠিক চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। দেশের প্রতিটি নাগরিককে সঠিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে গড়িমসি করার কোনো সুযোগ নাই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দিন যত যাচ্ছে আক্রান্তের হার তত বেশি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে গরিব দেশ হিসেবে আমরা সামাল দিতে পারবো কিনা এ নিয়ে সংশয় আছে। কাজেই সংক্রমণ আর যাতে না বাড়ে, সেদিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া দরকার।
করোনা আমাদের দেখিয়ে দিল দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কত দুর্বল। কোনো কোনো সময় সাধারণ রোগী পর্যন্ত করোনা সন্দেহে চিকিৎসা না পেয়ে এ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ছোটাছুটি করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। টেলিভিশনে দেখেছি, দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডফোর্ড হাসপাতালের সামনে অসুস্থ স্বামীকে ভ্যানের উপর রেখে স্ত্রীর আহাজারী, করোনা সন্দেহে কেউ এগিয়ে আসেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেছি, একই পরিবারের সবাই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্ত্রী-সন্তানের সামনে আপনজন ভেন্টিলেশনের অভাবে ছটফট করে মারা যেতে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা সন্দেহে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি, ডায়রিয়া, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসা ঠিকমত হচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই সমস্ত অবহেলার কারণে, এই সমস্ত জরুরি রোগী ও অভিভাবকরা হাসপাতালে যেতে অনিহা প্রকাশ করায়, বিনা চিকিৎসায় অনেকেই বাড়িতেই মৃত্যু বরণ করছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, ইতোমধ্যে ১ জন মন্ত্রীসহ ঊর্দ্ধতন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাছাড়া এপর্যন্ত সারাদেশে ২০ জন বিচারক, ১৫ জন এমপি করোনা আক্রান্ত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদশ্য বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি এস. আলম গ্রুপের পরিচালক, ৫টি ব্যাংক সহ ৩৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক মোরশেদুল আলম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১টি ভেন্টিলেশনের অভাবে পরিবারের সকলের সামনে করুণ মৃত্যু বরণ করেন। দেশে এস.আলম গ্রুপের মতো অনেক শিল্পপতি, আমলা, জনপ্রতিনিধি আছেন, যাদের সাধারণ জ্বর-কাশিতে চিকিৎসা ও চেকআপের জন্য বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আসেন। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েও মোরশেদুল আলম সাহেবকে সামান্য ১টি ভেন্টিলেশনের জন্য মারা যেতে হবে এটা কল্পনার অতীত। এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। শুধু সরকার নয়, সমাজের বিত্তবানরা চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে খেয়াল করলে হাজার হাজার ভেন্টিলেটর আই.সি.ইউ সংযুক্ত হাসপাতাল তৈরি করা সম্ভব ছিল, এতে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ দেশের মানুষ উপকৃত হতো।
দেশ উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে শিক্ষা ও চিকিৎসা। স্পর্শকাতর এ দুটি বিষয়কে কোনো ভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নাই, কিন্তু দুর্নীতি অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই দুটি বিষয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিকিৎসা খাতে বাজেট ছিল ২৫ হাজার ৭শত ৩২ কোটি টাকা। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকার কারণে মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে, অনেক কষ্ট ও ব্যয়বহুল হলেও সঠিক চিকিৎসা নিতে ভারতসহ বিদেশে যেতো। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে করোনা সংক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের দেশ থেকে প্রতিদিন শুধু ভারতে ৮ থেকে ১০ হাজার লোক যেতো। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক লোকই চিকিৎসার জন্যই ভারতে যেতো। এছাড়া ধনী, উচ্চবিত্তরা পৃথিবীর উন্নত দেশে যেমন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সৌদিআরব, ইংল্যান্ড, আমেরিকায়, চিকিৎসা ও শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য যেতো। বিদেশে চিকিৎসা করতে যাওয়া লোকদের থেকে জানা যায়, দেশে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়া, চিকিৎসকদের রোগী দেখার ক্ষেত্রে অমনোযোগী, দুর্ব্যবহার, কম সময় দেওয়া, রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অহেতুক অধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেওয়া, ডাক্তারের মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো, এসব নানা কারণে দেশে চিকিৎসার উপর আস্থা না থাকায় তারা বিদেশে সঠিক চিকিৎসার জন্য যেতে বাধ্য হন। এছাড়া অনেক সময় ভুল চিকিৎসার কারণে জীবন বাঁচানোর জন্য তারা বিদেশে যান। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য কোটি কোটি টাকা বিদেশে দিয়ে আসছেন। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর অনাস্থার কারণেই তারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্রায়ই গিয়ে থাকেন। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকার কারণ, প্রয়োজনীয় দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি না হওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা, মেধাবী চিকিৎসকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা, কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়াও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে জরুরি রোগী দেখানোর ক্ষেত্রে অধিক সিরিয়াল। বেশির ভাগ নির্ভুল রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক ডায়গনস্টিক সেন্টারের সাথে অন্য ডায়গনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে মিল না থাকা। টেকনিশিয়ানের অভাব, প্রয়োজনীয় ডাক্তারের স্বল্পতা, ডাক্তারদের বাসা ও চেম্বারের অভাব, নিরাপত্তার অভাব, এছাড়া প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। দেশে প্রতি বছর ৩৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ৪ হাজার ৬৮ জন ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে ৬ হাজার ২৩৩ জন অর্থাৎ ১০ হাজার ২৯৯ জন কমবেশি ডাক্তার বেরিয়ে থাকে, অথচ হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের সংকট প্রায় লেগেই থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো চিকিৎসার ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। গ্রিসে ২২৮ জনে ১ জন ডাক্তার, স্পেনে ২০০ জনে ১ জন ডাক্তার, অস্ট্রেলিয়ায় ২৯৫ জনে ১ জন ডাক্তার, ফ্রান্সে ২৯৬ জনে ১ জন ডাক্তার, আমেরিকায় ২৭৮ জনে ১ জন ডাক্তার সেবা দিয়ে থাকেন। তথ্যমতে, আমাদের দেশে ১৮৪৭ জনে ১ জন ডাক্তার নিয়োজিত আছে। প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০/২৫ জন ডাক্তারের বসার জায়গার ও আবাসিক (থাকার জায়গা) সংকট রয়েছে। তাদের ন্যূনতম নিরাপত্তা নাই। হাসপাতালগুলো নিজেরাই রোগী হয়ে আছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব, কিছু কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনেক অভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ডিগ্রী নেওয়ার ক্ষেত্রে আসন একেবারেই কম। তাছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করার কারণে বেশির ভাগ চিকিৎসক দেশের বাইরে চলে যায়, ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকের স্বল্পতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। উপজেলা শহর গুলোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পোস্ট থাকলেও অধিকাংশ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই বললেই চলে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সরকারী হাসপাতালগুলোতে যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে আবার অনেক হাসপাতালে যন্ত্রপাতি থাকলেও টেকনিশিয়ানের অভাব আছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিছু ডাক্তারের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটা বড় কমিশন বাণিজ্য রয়েছে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্টের ফলাফল এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে অন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টরের সাথে মিল থাকে না। অনেক ডাক্তারের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্ট না করলে গ্রহণ করতে চান না। এ অবস্থার পরিবর্তনে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থারই সংস্কার প্রয়োজন। সঙ্গতকারণেই উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য বাজেটে চিকিৎসা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে, এতে করে দেশ উন্নয়নের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। তাছাড়া দেশে সঠিক চিকিৎসা পেলে, অধিক ব্যয়ে, অনেক কষ্টে দুঃসময়ে আপনজন ছাড়া বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসায় বিশ্বাস সৃষ্টি হলে আশেপাশের দেশ থেকে রোগী এ দেশে চিকিৎসা নিতে আসবে, এতে করে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, অনেক বেকার সমস্যা দূর হবে ও অধিক হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে। দেশের মানুষের সকল চিকিৎসা দেশেই হলে, কষ্ট লাঘব হবে, কম টাকায় চিকিৎসা পাবে ও দুঃসময়ে আপনজন কাছে থাকবে এবং ভবিষ্যতে করোনা ভাইরাসের মতো বিপর্যয় মোকাবিলা করা সহজ হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শুধু সরকার নয়, দেশের বিত্তবানরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে, এস. আলম গ্রুপের পরিচালক, মোরশেদুল আলমের মতো হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েও সামান্য একটি ভেন্টিলেটরের জন্য আর কাউকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন