কী অমানবিকতা! নিষ্ঠুরতা! দেখামাত্র গুলি! এটাই কী হতে পারে কোনো বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নীতি ও আচরণ? এটাই কী বন্ধুত্বের নমুনা! লেখাপড়া না জানা ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বাংলাদেশি যুবক আব্দুল জলিলের মৃত্যু অবশ্যই সম্মানজনক হয়েছে। কারণ, সে কোনো অপরাধী ছিলো না। কিন্তু চীনা সৈন্যদের হাতে লোহার রডের ওপর পেরেক লাগানো লাঠির ধোলাই খেয়ে ভারতীয় ২০ সেনা নিহত হওয়া কোন সম্মানজনক মৃত্যু নয়। গত ১০ বছরেই বিএসএফের গুলিতে সাড়ে ৩ শতাধিক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার গোবরাকুড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে গত ২২ জুন বাংলাদেশি যুবক আব্দুল জলিল নিহত হন। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে নিহত ওই যুবকের লাশ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে হস্তাস্তর করে বিএসএফ। নিহত আব্দুল জলিল উপজেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম গোবরাকুড়া গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে। তার পরিবার জানিয়েছে, জলিল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। আব্দুল জলিলকে হত্যা বিএসএফের উদ্ধত, নির্লজ্জ, দম্ভপূর্ণ, আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ বরাবরই একটি উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠনের মত কর্মকান্ড করে থাকে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের কোনো সীমান্তবিরোধ নেই। সীমান্তে কোনো যুদ্ধাবস্থাও নেই। অথচ বাংলাদেশীরা ভারতীয় সীমান্তবাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে। অত্যাচার, নির্যাতন, অপহরণ, আটক সবসময় হচ্ছে। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা ‘দুষ্কৃৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে’। তাহলে মানসিক ভারসাম্যহীন নিরস্ত্র যুবক আব্দুল জলিলও কী দুষ্কৃতকারী ছিলো? চীনের শক্তিমত্তার কাছে অসহায়ত্ব ভারতের জন্য নতুন ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের সাথে পেশিশক্তি দিয়ে ভারত মোকাবেলা করবে, তা সম্ভব নয়। সামরিক, শারীরিক ছাড়াও মানসিক শক্তিতেও যে চীনারা অগ্রসর সেটা গলওয়ানকান্ডে বোঝা যাচ্ছে। সমুদ্র সমতল থেকে ১৪ হাজার ফুট উপরে এবং হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় ভারতীয় সৈন্যদের মৃত্যু, নিখোঁজ ও আটকের খবর চীনাদের মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যরে প্রমাণ দেয়।
অবৈধভাবে কেউ কোনো দেশে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে হত্যা করতে হবে কেন? তাকে ধরে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে। সরকারের নীরবতার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বাহিনী মাস্তানি আচরণ করে সীমান্তে একের পর এক বাংলাদেশিকে হত্যা করে চলেছে। অনুমতি ছাড়া সীমানা পার হলে গ্রেপ্তার করতে পারে, গুলি করে মারবে কেন? যে দেশ সীমান্তে দেখামাত্র গুলি করে, তারা কি করে বন্ধুরাষ্ট্র হতে পারে? এ ধরনের অহেতুক অন্যায় হত্যাকান্ডের কারণেই বাংলাদেশিরা চীনাদের ভূমিকা সমর্থন করছে। সীমান্তে এ অমানবিক হত্যাকান্ডের জন্যে ভারত কখনোই বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন পাবে না। ভারত কখনো যদি তার সীমান্তবর্তী কোন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনোই ভারতের পাশে থাকবে না। গলওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও বাংলাদেশের মানুষকে মোটেই সহানুভূতি প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। চীনের শক্তিমত্তাকে নিজেদের অক্ষম প্রতিশোধ গ্রহণের অক্ষমতার ঘাটতিপূরণ মনে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লসিত হয়েছে অনেকেই।
বরাবরই দেখা যায়, হত্যার পর পতাকা বৈঠক? বাংলাদেশ কি এজন্যই স্বাধীন হয়েছিল যে, ভারতের সীমান্তরক্ষীরা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করে নিরীহ জনগণকে হত্যা করবে? ২০১৮ সালে এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হলেও বিএসএফ তাই করছে। একই ধরনের চুক্তির কার্যকারিতা চীনের সাথে ভারত অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। গলওয়ানে কমপক্ষে ২০ সৈন্য হত্যা ও ১০ জন অপহৃত হওয়ার পরও চীন সীমান্তে ভারত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের নাগরিকদের এভাবে নির্মমভাবে হত্যার পরও কেন নীরব থাকে? বিজিবির কাজ কি বিএসএফ গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেরত আনার জন্য শুধু পতাকা বৈঠক করা? সীমান্ত হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ ভুলবশত বা অবৈধভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে, বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি অনুযায়ী তাকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু বিএসএফ সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ না করে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিএসএফকে বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সীমান্তে যাতে একজনও মারা না যায়, সে ব্যাপারে ভারত বহুবারই অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে, সীমান্ত হত্যা ঘটছেই।
যুদ্ধাবস্থা ছাড়া সীমান্তে এতো হত্যা পৃথিবীর আর কোথাও আছে কী? দেখা যাচ্ছে, বিএসএফ কর্তৃক বেশিরভাগ হত্যাকান্ডই সীমান্তের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ অংশে ঘটে থাকে, যা সুস্পষ্টভাবে সার্বভৌমত্বের লংঘন। নওগাঁর পোরশা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে গত ২২ জানুয়ারি ৩ বাংলাদেশি নিহত হয়। এর মধ্যে দুই বাংলাদেশির মৃতদেহ বিএসএফ সদস্যরা নিয়ে যায়। নিহতরা ছিলেন নওগাঁ সদর উপজেলার বিষ্ণুপুরের শুকরা কুমারের ছেলে রনজিত কুমার, চকবিষ্ণুপুর দিঘীপাড়ার মৃত খোদাবক্সের ছেলে মফিউ উদ্দিন ৩৮ ও কাঁটাপুকুর গ্রামের মৃত জিল্লুর রহমানের ছেলে কামাল আহমেদ। গুলি করে তিন বাংলাদেশিকে হত্যার কথা বিএসএফ স্বীকার করে তখন দুঃখ প্রকাশ করেছে। পরে পতাকা বৈঠক করে বিজিবি ঘটনাস্থল থেকে দুজনের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে। আমরা মনে করি বিজিবির কাজ শুধু পতাকা বৈঠক করে লাশ গ্রহণ করা নয়।
ভারত সীমান্তে বরাবরই অসহিষ্ণু আচরণ করে থাকে। তারা ধারণা করে থাকে, বাংলাদেশ সব সময়ই নীরবে সব মেনে নেবে। সীমান্তের এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা অতি জরুরি। বিএসএফকে বুঝিয়ে দিতে হবে, বীর বাঙালী দুর্বল কাপুরুষ নয়। অবশ্য আমাদের গর্বের বিজিবি ইতিপূর্বে সেটা করেও দেখিয়েছে। গুলি যে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের বন্দুকেও আছে তা ভালো মতোই প্রমাণিত হয়েছে ২০০১ সালের রৌমারীতে, ২০০৫ সালের আখাউড়া ও ২০১৯ সালের পদ্মায় গুলিবিদ্ধ বিএসএফের নিথর দেহ পড়ে থাকার সময়। নিরস্ত্রকে গুলি না করার জন্য বিজিবির নীতির কারণেই বারবার প্রাণে বেঁচে যায় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা।
বাংলাদেশের বিজিবি ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের প্রতি আন্তর্জাতিক আইন মেনে অনেক মানবিকতার পরিচয় দিয়ে থাকে। কেউ অপরাধী হয়ে থাকলে, তার বিচারের পরিবর্তে নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা করা কোন আইনে আছে? তবে বাংলাদেশী ফেলানী হত্যার হৃদয়বিদারক ও পৈশাচিক দৃশ্য এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে রয়েছে। ফেলানীকে মেরে কাঁটা তারের উপর ঝুলিয়ে রেখেছিলো বিএসএফ। ফেলানির লাশটা এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ১৫ বছরের ওই কিশোরীর ঝুলে থাকা লাশ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বীভৎস দিক বিশ্ববাসী তখন দেখেছে। কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যাওয়া মেয়েটিকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী গুলি করে। ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সদস্যরা মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। বিএসএফের আক্রমণের ভয়ে কেউ ফেলানীকে উদ্ধারে তার কাছেও যায়নি। সেদিন দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ফেলানীর লাশ উল্টো হয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে রয়েছিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন