বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গরু নিয়ে বিপাকে ভারত

প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গরু নিয়ে মহাবিপাকে পড়ে গেছে ভারত সরকার। এতদিন জ্যান্ত গরু নিয়ে নানা সমস্যা ছিল। এখন তাতে যোগ হয়েছে মরা গরু। প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটে দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর মরা গরু সরাবে না। সমান নাগরিক অধিকার না দিলে তারা তাদের এই সিদ্ধান্ত ও অবস্থান থেকে সরে আসবে না। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উদ্দেশে তারা সাফ এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে, ‘গরু তোমাদের মা। রাস্তাঘাটে ও গোয়ালে মরে থাকা গরু তোমরাই সরাও।’ দলিতদের এই সিদ্ধান্ত ও অবস্থানের কারণে গুজরাটের বাড়িঘরে শত শত মরা গরু পড়ে আছে। মরা গরুতে পচন ধরায় দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। পরিবেশ নিয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাপক শঙ্কা। দি হিন্দু পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, গুজরাটের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় অন্তত ৫শ’ থেকে এক হাজার মরা গরু পড়ে রয়েছে। কয়েকদিন ধরে পচা-গলা গরু পড়ে থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রশাসনের লোকজন ট্রাক দিয়ে গরু সরানোর প্রস্তাব করেছে। আগে প্রতি গরু সরানোর জন্য দুইশ’ টাকা দেয়া হতো। এখন পাঁচশ’ এমনকি এক হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পরও দলিতরা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। তারা সম-অধিকারের দাবিতে বড় ধরনের আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা আহমেদাবাদে একটি দলিত সমাবেশের ডাক দিয়েছে যাতে আশেপাশে দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন অংশ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হঠাৎ করে বা কারণ ছাড়াই দলিতরা এভাবে বেঁকে বসেছে, ব্যাপারটি সেরকম নয়। গত ১১ জুলাই মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোর ‘অপরাধে’ দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে নগ্ন করে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে মারধর করে গো-রক্ষা সমিতির লোকেরা। এতে দলিতরা ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারা ভারতে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সংসদে বিতর্কের ঝড় ওঠে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ দলিতদের পক্ষে সোচ্চার হয়। দলিতরা নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম-অধিকারের দাবিও যুক্ত করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, দলিতরা হিন্দু বলে পরিচিত হলেও উচ্চবর্ণের কাছে অচ্ছুত। তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য। সেখানে দলিত নির্যাতন নিত্য ঘটনা। সম্প্রতি মন্দিরে প্রবেশে বাধা দেয়ায় তামিলনাড়–র ২৫০টি দলিত পরিবার ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কয়েকটি পরিবার ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে।
ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে পরিচিত হলেও ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার দিক দিয়ে বিশ্বে তার অবস্থান শীর্ষে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতন-নিপীড়ন সবচেয়ে বেশি হয় ওই দেশটিতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেখানে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অসহিষ্ণুতা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার শিকার হচ্ছে প্রধানত বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলমানরা। বিজেপির ক্ষমতায় আসার সুযোগে সেখানকার হিন্দুত্ববাদীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গরুর গোশত মুসলমানদের হালাল খাদ্য। খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রিয় খাদ্য। এমনকি হিন্দুদেরও অনেকে গরুর গোশত খায়। কিন্তু যেহেতু তা মুসলমানদের খাদ্য তাই গো-রক্ষা আন্দোলনের নামে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। গত বছর উত্তর প্রদেশের দাদরিতে ফ্রিজে গরুর গোশত থাকার মিথ্যা অভিযোগে এক মুসলিম পরিবারের ওপর হামলা চালানো হয় এবং পরিবারপ্রধান আখলাক আহমেদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী গো-রক্ষা আন্দোলনের লোকজনদের হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি মধ্য প্রদেশের এক রেল স্টেশনে দুই মুসলিম নারীকে পুলিশের সামনেই গরুর গোশত পাওয়ার মিথ্যা অভিযোগে ব্যাপক মারধর করা হয়। যদিও তাদের কাছে গরুর নয়, পাওয়া যায় মহিষের গোশত। গরু ও গরুর গোশত এখন সাম্প্রদায়িক হামলা এবং নির্যাতন-পীড়নের এক মস্ত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শুধু মুসলমান নয়, দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরাও এখন রেহাই পাচ্ছে না।
গো-রক্ষা আন্দোলন জোরদার হওয়ার প্রেক্ষিতে, অনেকেই জানেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই ও গরুর গোশত রাখা বা খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশেষভাবে ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। হঠাৎ করে সেখান থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশ সাময়িকভাবে বেশ অসুবিধায় পড়ে। গরুর গোশতের দাম রাতারাতি বৃদ্ধি পায়। কোরবানির গরুর সংকট দেখা দেবে বলে আশংকা করা হয়। সে আশংকা অবশ্য সত্য হয়নি। কোরবানির গরুর অভাব হয়নি। বাংলাদেশে গরু রফতানির মাধ্যমে ভারত প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত, কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে সেই আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, গরু জবাই ও গরু রফতানি নিষিদ্ধ হওয়াতে ভারতের গরুর খামারের মালিক ও কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সাধারণত বয়স্ক ও বৃদ্ধ গরু যখন কাজকর্মের অযোগ্য হয়ে পড়ে তখন বিক্রি করে দেয়া হয়। গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ায় এসব গরু খামারি ও কৃষকদের মাথার বোঝায় পরিণত হয়েছে। গরু মেরে ফেলারও উপায় নেই। এ অবস্থায় গরু স্বাভাবিকভাবে না মরা পর্যন্ত তাদের আহার যোগান দিতে হচ্ছে খামারি ও কৃষকদের। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং গরু পালন নিরুৎসাহিত হচ্ছে। জানা গেছে, একই কারণে ভারতের চামড়া শিল্পে মারাত্মক ধস নেমেছে। চামড়াজাত পণ্যের বাজার ছত্রখান হয়ে গেছে। গরুর গোশত রফতানিতেও ধস নেমেছে। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, গরুকে মাতা বা পূজ্যজ্ঞানে যে দেশে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই দেশটি গরুর গোশত রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০১৩ সালে ভারত ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টন গরুর গোশত রফতানি করে। এ এক বিশাল বৈপরীত্য। হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করতে গরু নিয়ে যা কিছুই করা হয়েছে বা হচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতের অর্থনীতি এবং সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। দলিতদের মরা গরু না সরানোর সিদ্ধান্তের পরিণতি কী দাঁড়ায়, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন