প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক স্তর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তর থেকে শিশু যেভাবে গড়ে উঠবে তার ভবিষ্যতেও তার প্রভাব থাকবে। তার লেখাপড়া থেকে আচরণিক বৈশিষ্ট্য সবই এ স্তর থেকে গড়ে ওঠে। এ স্তরের পরিবেশ এবং শিক্ষকদের দক্ষতা, আন্তরিকতা অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রতিনিয়তই প্রাথমিক স্তরকে উন্নয়নের জন্য, কাক্সিক্ষত ফল লাভের জন্য, শিক্ষার ভিত্তি শক্তিশালী করতে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথেই সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। শিক্ষার্থীকে স্কুল পোশাকের টাকা দেয়া একটি যুগোপযুগী পদক্ষেপ। তাদের সেই অর্থ হয়তো খুব দ্রুতই দেয়া হবে। দেশের লাখ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জন্য এতসব নিশ্চিত করা যে বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এসব উদ্যোগ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এবং এর গুণগত মানকে আরও বেশি কার্যকর করে তুলবে। এতদিন বছরের শুরুতে নতুন বই নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরতো শিক্ষার্থীরা। এখন তার সাথে যদি স্কুলের পোশাকও হাতে পায় তাহলে আনন্দের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। প্রাথমিক শিক্ষায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে চলেছে দীর্ঘ দিন ধরেই। সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ডিজিটালাইজেশনের সাথে সাথে আনুষঙ্গিক এসব সুবিধা প্রাথমিক শিক্ষাকে অভিভাবকের নিকট আরো গ্রহণযোগ্য হতে সাহায্য করবে। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মাসিক উপবৃত্তি দেওয়া হয়। চলতি বছর এই উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির আগে আরেকটি শ্রেণি খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ,স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরও সুযোগ সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে।
দেশের দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলগুলোতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিস্কুট দেয়া হয়। এখন সরকার মিড ডে মিল দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। দেশের অনেক স্থানেই মিড ডে মিল চালু হয়েছে। এই বিস্কুট দেয়া বা মিড ডে মিল চালু করা এসবের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা। এই হার একশ ভাগে উন্নীত করা। মিড ডে মিল বিস্কুট দেয়ার থেকে অনেক বেশি কার্যকর হবে এ কথা নিশ্চিত। প্রাথমিকের শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক একজন দক্ষ শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দক্ষ কারণ যে এসব শিক্ষকদের নিয়মিতভাবে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শিক্ষকদের শিশুদের শিক্ষাদানের পদ্ধতির উন্নয়ন করা। তাহলে এত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক যে স্কুলগুলোতে শিক্ষা দেয় সেসব স্কুলের ওপর এখনও মানুষের শতভাগ আস্থা হবে না কেন? এসব পাওয়া প্রশিক্ষণের কতটা সে শ্রেণিতে প্রয়োগ করে সেটার ওপর নির্ভর করে প্রশিক্ষণের সাফল্য। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের পদক্ষেপে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। আর পেস্কেল ঘোষণার সাথে সাথে শিক্ষকদের বেতনও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আরও একটু বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সকল শিক্ষাস্তরের ভিত্তি। সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উপর আস্থা এবং কিন্ডারগার্টেন নির্ভর শিক্ষার প্রভাব কমাতে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের আন্তরিক হতে হবে এবং নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। সমস্যা থাকবে কিন্তু সমস্যা এই স্তরকে থামাতে পারবে না। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে গেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌছে দিয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছে তারা সর্বোচ্চ শিক্ষিত। এতদিন মেয়েদের ক্ষেত্রে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল আগামী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে তা পুরুষ ও মহিলা সমান যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। খুব সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ঘোষণা এসেছে। খুব তাড়াতাড়িই এই বিজ্ঞপ্তি হয়তো আসবে। এখন সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি মানেই প্রচুর আবেদন জমা পরা। অন্তত করোনা কালীন সময়ে বেসরকারি চাকরিতে নিরাপত্তাহীনতা এবং বিপরীতে সরকারি চাকরির নিরাপত্তা ও সুবিধার কারণে সরকারি চাকরিতে সবার ঝোঁক বেশি। সামনের যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসবে তারাও শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে যথেষ্ট যোগ্য। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকদের কয়েকটি বিষয়ও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষাসহ শিক্ষার সব স্তরে মেধাবী এবং আন্তরিক মানুষ প্রয়োজন যারা কেবল শিক্ষকতাকেই নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে দেখে থাকেন। এমন এক সময় আসবে যখন একজন তার মেধাকে সরকারি অন্য উচ্চ শ্রেণির চাকরিতে না দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করবে। এটা হয়তো অনেক দূরের কল্পনা। কিন্তু শিক্ষার জন্য উত্তম। একজন সহকারি শিক্ষক হিসেবে যখন কেউ যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকুরির আশা করতে পারে। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে ততটা নেই। সহকারি শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ।
মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে শিক্ষকদের মনের কথা শুনতে হবে। দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩ করা হয়েছে। যদিও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষকদের দাবি ছিল ১১ গ্রেড। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দাবি ১০তম গ্রেড। কোনো শিক্ষকই কেন তৃতীয় শ্রেণিতে চাকরি করবেন? সহকারি প্রধান শিক্ষকদের একটি পোস্টে সহকারী শিক্ষকদের পদন্নোতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। যেকোনো চাকরিতে পদন্নোতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেবল বেতনের জন্যই সবাই চাকরি করে না। পদোন্নতির আশা মনের ভেতর লুকিয়ে রাখে সবাই। অন্যান্য সরকারি চাকরির মতো প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরিতেও পদোন্নিতর সুযোগ থাকা উচিত এবং এটা তাদের পেশাগত দক্ষতা, কাজের প্রতি স্পৃহা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর কেউ যখন তার মেধা এবং দক্ষতা, কাজের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎসাহ না পায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পার হলেও সেই পদ থেকে পদন্নোতি না হয় তখন তার মনে হতাশা বিরাজ করে। আর সেটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকেই তার কাজের মূল্যায়ন চায়। সেই মূল্যায়ন যে কেবল বেতন বৃদ্ধির ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে এমন ধারণা ঠিক নয়। চাকরিতে পদন্নোতি থাকা তাই একান্ত আবশ্যক। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে এটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে প্রাথমিক শিক্ষকদের পদন্নোতিতে কাজ চলছে এমন খবর শোনা গেছে। সেটা দ্রুত বাস্তবায়ন হোক এটা প্রত্যাশা করি। একজন সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর নির্দিষ্ট সময় শেষে সহকারি প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক,সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে শিক্ষকদের মধ্যে আগ্রহ সঞ্চার হবে। তারা তাদের দায়িত্ব পালনে সচেতন হবে। কারণ এই পদন্নোতির মাপকাঠি যদি শিক্ষকদের মেধা, দক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনায় হয় তাহলে তারা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করবে। তারা তাদের কাজে অসন্তুষ্টি থাকবে না এবং সর্বোচ্চ সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেয়ার কাজটি করে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন