রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ইসলাম

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুফতী পিয়ার মাহমুদ

॥ এক ॥
পুরো ধরিত্রী আজ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত। যত্রতত্র হত্যা আর হামলার শিকার হচ্ছে মানব ও মানবতা। লাশের মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। বিশেষ করে মুসলিম কান্ট্রিগুলো-এর নির্মমতার শিকার ভয়ানকভাবে। এ নিমর্মতা থেকে বাদ পড়েনি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও। আক্রান্ত হয়েছে নিমর্মভাবে। দেশের ইতিহাসের সবচে ঘৃণ্য ও নৃশংস হামলাটি হয়েছে পবিত্র মাহে রামাজান ও ঈদের দিনে। যার বীভৎস বিবরণ জাতির নখর্দপনে। ইসলাম বিরোধী শিবির ও মুসলিম নামধারী তাদের দালালচক্র এ সকল সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী হামলা ও আক্রমণের দোষ ও দায় চাপাতে ব্যস্ত শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর উপর। মানবতার ধর্ম ইসলামকে বিশ^বাসীর কাছে চিত্রায়িত করছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ও চরমপন্থার ধর্ম রূপে। মুসলিম উম্মাহকে আখ্যায়িত করছে সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী, উগ্রবাদী ও চরমপন্থী হিসাবে। অথচ ইসলাম শান্তি, মানবতা ও কল্যাণের ধর্ম। এতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ যে কোন ধরনের চরমপন্থা ও উগ্রবাদ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-“যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করার অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল আর যে কারও জীবন রক্ষা করল সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষের জীবনই রক্ষা করল।” (মায়েদাহ : ৩১২) আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-“আর যখন তারা ফিরে যায়, তখন চেষ্টা করে যেন সেখানে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ধ্বংস ও প্রাণনাশ করতে পারে। মূলত আল্লাহ তাআলা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা পছন্দ করেন না। (বাকারা : ২০৫) সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কায়দায় কাউকে হত্যা করাও হারাম ও মহাপাপ। ইহপার ও পরপারে রয়েছে সুকঠিন শাস্তির বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে কেউ কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করল, তার শাস্তি জাহান্নাম। তথায় সে থাকবে দীর্ঘকাল। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভয়ঙ্কর শাস্তি। (নিসা : ৯৩) বর্ণিত আয়াতে কোন মুমিনকে হত্যা করলে যে চারটি শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে, তার যে কোন একটির কথা শুনলেও মানব শরীর শিউরে উঠে। সুতরাং যার উপর সেই শাস্তিগুলো প্রয়োগ করা হবে তার অবস্থা কি হবে? অতএব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী সম্প্রদায়! একবার ভেবে দেখবেন কি? অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-“আর তারা সঙ্গত কারণ ব্যতিত তাকে হত্যা করে না যাকে হত্যা করা আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন এবং লিপ্ত হয় না ব্যভিচারে। যারা এ অপরাধ করবে, তারা সম্মুখীন হবে কঠিন শাস্তির। তাদের এ শাস্তি বর্ধিত করা হবে এবং তথায় তারা থাকবে চিরকাল।” (ফুরকান : ৬৮-৬৯) হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- “কিয়ামত দিবসে সর্ব প্রথম রক্তপাত তথা হত্যার বিচার হবে।” (বুখারী : ৬৫৩৩, ৬৮৬৩; মুসলিম : ১৬৭৮) অন্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আমাদের উপর (কোন মুসলমানের উপর) অস্ত্র উত্তোলন করে সে আমদের দলভুক্ত নয়।”(বুখারী : ৬৮৭৪, ৭০৭০; মুসলিমু : ১৬১) অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “মুসলমানকে গালি দেয়া ফিসক আর তাকে হত্যা করা কুফরী কাজের অন্তুর্ভুক্ত।”(বুখারী : ৪৮,৬০৪৪; মুসলিম : ১১৬) সাহাবী আবু হুরায়রার (রা.) বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! মানুষ এমন এক যামানার মুখোমুখী হবে, যখন হত্যাকারীও জানবে না যে, কেন সে হত্যা করল। নিহত ব্যক্তিও জানবে না যে, কেন তাকে হত্যা করা হলো। জিজ্ঞাসা করা হলো, এমনটি কিভাবে হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, হত্যাযজ্ঞ ব্যাপক আকার ধারণ করার ফলে। এই হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়েই হবে জাহান্নামী। (মুসলিম : ২৯০৮) মানবতার ধর্ম ইসলাম কেবল মুসলমানের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা দিয়েই ক্ষ্যন্ত হয়নি; বরং মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিম ও সংখ্যালুঘু সম্প্রদায়ের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুরও নিরাপত্তা দিয়েছে সমধিক। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের (রা.) বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কোন যিম্মীকে (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোন কাফেরকে) হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছর দূরের পথ হতেও পাওয়া যাবে।” (বুখারী : ৩১৬৬, ৬৯১৪) অন্য বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “সাবধান! (জেনে রাখ) যে কেউ কোন যিম্মীর (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোন কাফেরের) প্রতি অবিচার করবে অথবা তার প্রাপ্য অধিকার কমিয়ে দিবে বা সামর্থ্যরে বাইরে কোন কাজ চাপিয়ে দিবে কিংবা তার আত্মিক তুষ্টি ব্যতিত তার সম্পদ ভোগ করবে, কিয়ামত দিবসে আমি তার প্রতিপক্ষ হয়ে তার অন্যায় অপরাধ প্রমাণ করব।”(আবু দাউদ : ৩০৫২) সুবহানাল্লাহ! সংখ্যালুঘু ও অন্য ধর্মালম্বীদের ব্যাপারেও কত অপূর্ব বাণী। এটা সম্ভব সেই সত্তার জন্যই, যিনি বিশ^ ও মানবতার নবী এবং যার ধর্ম বিশ^ ও মানবতার ধর্ম। এতো গেল সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদীদের পরকলীন শাস্তি ও হুঁশিয়ারী। এর ইহকালীন শাস্তিও বড় কঠোর ও নির্মম। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও দুশমনী করে এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে, মৃত্যুদ- বা শূলিবিদ্ধ করে হত্যা করা অথবা হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা নির্বাসিত তথা কারাগারে নিক্ষেপ করা। এতো হলো কেবল তাদের পার্থিব অপমান। পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়ঙ্কর শাস্তি।”(মায়েদাহ : ৩৩) অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-“হে ঈমানদারগণ! মানব হত্যার ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান ফরজ করা হয়েছে। (কিসাসের বিবরণ হলো) স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যার বদলে স্বাধীন, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস, নারীর বদলে নারীকে হত্যা করা হবে। তবে যদি তার ভাই তথা মৃত ব্যক্তির ওয়ারীশদের তরফ হতে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তাহলে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তার দেয় আদায় করবে। এটা তোমাদের প্রভুর তরফ হতে হত্যাকারীদের উপর সহজ করণ ও অনুকম্পা। এরপরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। হে বোধ সম্পন্ন লোক সকল! (জেনে রাখ) কিসাসের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন। যাতে তোমরা হতে পার সাবধান।”(বাকারা : ১৭৮-১৭৯)উক্ত আয়াত এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য আয়াতও হাদীসগুলোর আলোকে মুফাস্্সিরীনে কিরাম লিখেছেন-কেউ যদি কাউকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে, নিহত ব্যক্তি যে ধর্মরেই হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, স্বাধীন হোক, আর ক্রীতদাস হোক হত্যাকারীকে মৃত্য- দেয়া হবে। মৃত্যুদ- কার্যকর করবে সরকার ও প্রশাসন। কোন ব্যক্তি, পঞ্চায়েত বা সংগঠনের এ বিধান কাযর্কর করার এখয়িার ও অনুমতি নেই। আর যদি নিহত ব্যক্তির ওলী ও উত্তারাধিকারীগণ কিসাস না নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে তাও পারবে। এটা তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। স্থান, কাল ও অবস্থা ভেদে প্রশাসন তার ব্যবস্থা নিবে। (মাআরিফুল কোরআন : ১/৪৮৪-৪৮৬; বুখারী : ২/১০১৪-১০১৬; মুসলিম : ২/৫৮-৬১)
কোরআন-হাদীস ও ইসলামী ফিকহ অধ্যয়ন করলে বুঝে আসে ইসলামী শরীআহ মূলত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী বা অন্য কোন কায়দায় মানব হত্যার দ-বিধিকে কঠোর করেছে তিনটি বিষয়কে নিশ্চিত করার লক্ষে। ১.জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২.শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা। ৩.নাগরিকদের সচ্চরিত্রবান করা ও বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষ করা। পাঠক! ভেবে দেখুন, কোন এলাকা কিংবা রাষ্ট্রে যদি মানুষের বসবাস, চলাচল ও কাজ-কর্ম নিরাপদ ও নির্বিঘœ করা হয়, যদি সে এলাকা বা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা হয় নিরপেক্ষ ও সুদৃঢ় আর নাগরিকগণ বেড়ে উঠে সুপথে ও সচ্চরিত্রবান হয়ে, তাহলে সে এলাকা বা রাষ্টে কি কখনও সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা, উগ্রবাদ ইত্যাদি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং সে এলাকা বা রাষ্ট্রের জনগণ কি সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও উগ্রবাদী হতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন