মুফতী পিয়ার মাহমুদ
॥ শেষ কিস্তি ॥
আর সে জাতির উন্নতি ও অগ্রযাত্রা কি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? মূলত ইসলাম ধর্ম আদ্যপান্ত এক কল্যাণময়ী ও মানবতাবাদী ধর্ম। এর শিক্ষা ও দীক্ষা হচ্ছে, মানব হবে মানবতাবাদী, কল্যাণ ও শান্তিকামী। সে অন্যের উপকার করবে। অন্যের ব্যথায় হবে ব্যথিত। ভুলেও কারো ক্ষতির চিন্তা করবে না। সাহাবী তামীমে দারীর (রা.) বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “ইসলামের মর্মকথা হচ্ছে, কল্যাণকামীতা। আমরা বললাম কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহ, কোরআন, রাসূল, মুসলমানদের ইমামগণ ও সকল জনসাধরণের জন্য।” (মুসলিম : ৫৫; আবু দাউদ : ৪৯৪৪; তিরমিযী:১৯২৬;বুখারী:৫৭) সাহাবী আবু হুরায়রার (রা.) বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে দুনিয়ার কোন বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামত দিবসের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন এবং ে যে ব্যক্তি কোন অভাবী বা বিপদগ্রস্তের প্রতি দুনিয়াতে সহজ আচরণ করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি দুনিয়া ও আখেরাতে সহজ আচরণ করবেন এবং যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন করবে,আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন করবেন এবং আল্লাহ তাআলা বান্দাকে ততক্ষণ সাহয্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সে অপরকে সাহায্য করতে থাকে।” (মুসলিম:২৬৯৯; বুখারী:৫৭;আবু দাউদ : ৪৯৪৬; তিরমিযী : ১৪২৫,১৯৩০,২৯৪৫; ইবনে মাজা : ২২৫) মূলত ইসলামের প্রবর্তক আলিমুল গায়েব আল্লাহ তাআলা। গোড়াপত্তনকারী সুক্ষদর্শী নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাই কোন বিধান প্রবর্তনের পূর্বে অগ্রপশ্চাত ভেবে সকল প্রকার ছিদ্র পথ বন্ধ করেই প্রবর্তন করেছেন। তাইতো খুন-জখম, মারামারী ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের প্রথম স্তর জগড়া-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, জুলুম-অত্যাচার, কাউকে কষ্ট দেয়া ইত্যাদি কর্মকা-কেও ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে বড় কঠোরভাবে। তিব্র ভাষায় হিংসার নিন্দা করে আল্লাহ তাআলা বলেন- “তারা কি মানুষের সাথে হিংসা করে এমন বিষয়ের জন্য যা কিছু আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে মানুষকে দান করেছেন? (নিসা : ৫৪) সাহাবী আবু হুরায়রার (রা.) বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে সর্ম্পূণরুপে বেচে থাক। কেননা হিংসা-বিদ্বেষ মানুষের নেক আমলকে সেভাবে খেয়ে ফেলে যেভাবে আগুন শুকনো লাকড়ী কিংবা খড়-কুটোকে খেয়ে ফেলে।” (আবু দাউদ : ৪৯০৩) ঝগড়া-বিবাদের নিন্দায় কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “আর এমন কিছু মানুষ আছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা আপনাকে চমৎকৃত করে। তারা নিজেদের মনের কথার ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষীরূপে পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে তারা মারাত্মক ঝগড়াটে লোক। (বাকারা : ২০৪) সাহাবী আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি অন্যায়ের উপর থেকে ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করল, তার জন্য জান্নাতের কিনারায় একটি বালাখানা নির্র্মাণ করা হবে। আর যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যয়ের উপর থেকে ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করল, তার জন্য জান্নাতের মাঝে একটি বালাখানা নির্র্মাণ করা হবে। আর যে ব্যক্তি স্বীয় আখলাক-চরিত্র সুন্দর করল, তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি বালাখানা নির্র্মাণ করা হবে। (তিরমিযী : ১৯৯৩) সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.)-এর বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “তোমার জন্য এ গুনাই যথেষ্ট যে, তুমি সবর্দা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকবে। অর্থ্যাৎ তোমাকে ধ্বংশ করার জন্য সবর্দা ঝগড়া-বিবাদই যথেষ্ট। (তিরমিযী : ১৯৯৪) সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.)-এর বাচনিক অন্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “তুমি তোমার ভাই অর্থাৎ অন্যের সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ো না।” (তিরমিযী : ১৯৯৫)
ইসলাম ও ইসলামের নবীর অনুসারীদের ভাল করে মনে রাখা দরকার, কোন মানুষকে সে যে ধর্ম-বর্ণ বা জাতিরই হোক না কেন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মাধ্যমে বোমা, গুলি, অত্মঘাতী হামলা বা অন্য কোন কায়দায় হত্যা তো অনেক বড় কথা; একজন কাফেরকেও অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া ইসলাম ও ইসলামের নবীর দৃষ্টিতে চরম ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ কাজ এবং দ-নীয় অপরাধ। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “যারা বিনা অপরাধে মুমিন নর-নারীকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও পাপের বোঝা বহন করে।”(আহযাব : ৫৮) সাহাবী আবু সিরমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে, আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন। আর যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন।” (তিরমিযী : ১৯৪০; আবু দাউদ : ৩৬৩৫; ইবনে মাজা : ২৩৪২; বুখারী : ২/১০৫৯) অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী আবু বকর (রা.) বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “অভিশপ্ত সেই ব্যক্তি যে কোন মুমিনের ক্ষতি করে বা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে।” (তিরমিযী : ১৯৪১) অন্য এক বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সাবধান! (জেনে রাখ) যে কেউ কোন যিম্মীর (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোন কাফেরের) প্রতি অবিচার করবে অথবা তার প্রাপ্য অধিকার কমিয়ে দিবে বা সামর্থ্যরে বাইরে কোন কাজ চাপিয়ে দিবে কিংবা তার আত্মিক তুষ্টি ব্যতিত তার সম্পদ ভোগ করবে, কিয়ামত দিবসে আমি তার প্রতিপক্ষ হয়ে তার অন্যায় অপরাধ প্রমাণ করব।” (আবুদাউদ : ৩০৫২) পরিশেষে বলতে চাই, মানব জাতির সর্ববিধ কল্যাণের জন্যই ইসলামের আগমন। ইসলামী বিধি-বিধান যে সমাজে যে জাতি যে কালেই প্রতিফলিত করেছে সফলতা তাদের পদচুম্বন করেছে। শান্তি-শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার সুফল ভোগ করেছে শতভাগ। বর্তমান পৃথিবীর কোন দেশেই পুরোপুরি ইসলামী আইন চালু নেই। তবে কোন কোন রাষ্ট্র ইসলামের ফৌজদারী আইন বাস্তবায়িত করেছে। এতে সাফল্যও পেয়েছে যথাযথ। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় সৌদি আরবের কথা। আমার দেখা মতে সে দেশে অপরাধীর সংখ্যা এতই কম যে, তাদের আদালতগুলোতে ধূলি-ময়লার স্তুপ পড়ে থাকে বিচারকার্য পরিচালনার অভাবে। যার দৃষ্টান্ত তথাকথিত উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে খোঁজে পাওয়া বড় মুশকিলই হবে। ইতিহাস সাক্ষী, ইসলাম পূর্ব যুগে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা ও উগ্রবাদের যে উত্থান ঘটেছিল, তার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া দুষ্কর। সেই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা ও উগ্রবাদকে সমাজ থেকে মূলোৎপাটন করে ইসলামের অনুসারীরা যে শান্তির সমাজ বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন তার উপমা পেশ করতে পৃথিবীর ইতিহাস অক্ষম। তাই বলি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা ও উগ্রবাদকে মূলোৎপাটন করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশে^ শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য, জনগণের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর হেফাজতের জন্য চলুন না একবার ফিরে যায় মহাপ্রজ্ঞাময় ¯্রষ্টা ও পালনকর্তার সর্বময় কল্যাণকর সেই বিধানাবলী ও জীবন ব্যবস্থার দিকে। অন্তত পরিক্ষামূলকভাবে। অসীম দৃঢ়তা আর আস্থার সাথে বলতি পারি, খোদায়ী বিধান ও জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে বতর্মান বিশে^র মাথা খারাপকারী সমস্যা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা ও উগ্রবাদ উৎখাত হবেই ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলুম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন