কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ রাস্তা ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। গতকালের পত্রপত্রিকায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে থৈ থৈ পানিতে তলিয়ে যাওয়া যানবাহনের ছবি ছাপা হয়েছে। উজানে পাহাড়িয়া ঢল ও বাঁধভাঙ্গা পানির বন্যা প্রতিরোধের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা আমাদের হাতে না থাকলেও কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ার এই বাস্তবতা অনিবার্য ছিল না। আমরা বেশ আগে থেকেই এবারের সম্ভাব্য বন্যায় ঢাকা শহর তলিয়ে যাবে, এমন পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম। লেখালেখির মাধ্যমে তা তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় পানিবদ্ধতা এবং বন্যার কারণগুলো সকলেরই জানা। সে সব জানা কথা পুনরায় তুলে ধরে তার প্রতিকারের আগাম ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। তাতে কোনো কাজ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বন্যার আগেই কয়েকদিনের মাঝারি বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাগুলো তলিয়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে, শহরের স্যুয়ারেজ সিস্টেম বা পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা কাজ করছে না। ঢাকা শহরের নাগরিক দুর্ভোগের এটি অতি পুরনো চিত্র। মেয়র নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা তিলোত্তমা ঢাকা, ক্লিন ঢাকা, গ্রীন ঢাকা, আধুনিক পরিবেশবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর এসব প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া যেন নগরবাসির ললাট-লিখন।
বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গল্প শুনছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অথচ দেশের রাজধানী শহরটি বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় উঠে আসছে। কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতেই রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ার এই দৃশ্য ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মৌসুমী বৃষ্টিতে রাজধানীর রাস্তা তলিয়ে নদী হয়ে যাওয়ার সচিত্র খবর বিদেশী গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়ে আসছে। ঢাকার জলাবদ্ধতাসহ নাগরিক দুর্ভোগের জন্য ড্রেনেজ সিস্টেমের অপ্রতুলতা, পয়নিষ্কাশন লাইনের পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা, নাগরিক সমাজের অসচেতনতা ও দায়িত্বহীন আচরণ, অপরিতল্পিত ও সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্মকান্ড, রাস্তা ও পয়:নিস্কাশন লাইনের সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ শুরুর পর তা দীর্ঘদিন ফেলে রাখাই মূলত দায়ী। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ড্রেনেজ সিস্টেমের সমন্বিত ও সময়োপযোগী সংস্কার-উন্নয়ন, বেদখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের পাশাপাশি শহরের চারপাশের নদীগুলোর সাথে খালের সংযোগপথগুলো উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা বলছেন নাগরিক সমাজ ও নগরবিদরা। ঢাকা শহরের চারপাশের নদীর সাথে শহরের ভেতরে বিদ্যমান খালগুলোর সংযোগ অবমুক্ত রাখার মাধ্যমে সহজেই শহরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখা সম্ভব। এটি কারো না বুঝার কথা নয়। দশকের পর দশক ধরে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে। এবারের বন্যায় ঢাকার তলিয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগেই। এর মধ্যে ময়লা-পলিথিনে জমাটবদ্ধ স্যুয়ারেজ লাইনের পরিচ্ছন্নতা ও সংস্কার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলে বন্যার পানি আসার আগেই শুধুমাত্র বৃষ্টিতে শহর তলিয়ে যাওয়ার দুর্ভোগ পোহাতে হত না।
করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী মোকাবিলার মাঝখানেই বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। করোনায় সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থমকে দাঁড়ালেও আমাদের কৃষি উৎপাদন থেমে থাকেনি। অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা ঠিক রাখতে সরকার কৃষির উপর বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে। চলতি বন্যায় ইতিমধ্যে উত্তরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন অপুরণীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বন্যার পানি রাজধানীতে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টির পানিতে শহরের প্রায় সব রাস্তা তলিয়ে যাওয়াকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যায় না। এটি আমাদের নগর কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অদক্ষতা, সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্বহীনতার ফল। দু’দিনের বৃষ্টিতে শহর তলিয়ে যাওয়ার পর ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসতে হবে কেন? দায়িত্বশীলরা আগে কোথায় ছিলেন? ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রতিটি মেট্টোপলিটান সিটিতে অভিন্ন বাস্তবতা বিরাজমান। নিত্য যানজট, কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়া, স্যুয়ারেজলাইন উপচে ময়লাপানি বেরিয়ে আসা, আইন লঙ্ঘন করে শহরের নদী, খাল, জলাভূমি ভরাট ও বেদখল হওয়ার বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও নগর কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। নদ-নদীগুলোর নাব্য রক্ষায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি রাজধানীর খালগুলো উদ্ধার এবং চারপাশের নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা জরুরি। একইসঙ্গে নাগরিক সমাজের দায়িত্বশীল ভূমিকাও নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। বছরের পর ধরে চলা নাগরিক দুর্ভোগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন