গৃহবন্দি শিশুদের নিয়ে এই সময়ে একটু বিশেষ ভাবেই দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। মূলত এই সময়ে শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এবং আচার-আচারন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার সর্বপরি বয়সভিত্তিক শিশুদের মনের ভাষা বুঝতে হবে। শিশুদের নিয়ে কী করলে ভালো সময় অতিবাহিত হবে, শিশুরা থাকবে হাসি-খুশি, শিশুর মানসিক অবস্থা থাকবে ফুরফুরে সেদিকে খেয়াল রেখে অবিভাবকদের আচার-আচরন করাটা প্রত্যেক দায়িত্ববান অভিভাবকের কর্তব্য। স্কুল, খেলার মাঠ, প্রাইভেট কোচিং, আর্ট বা গানের শিক্ষক, ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় চার দেয়ালের মধ্যেই শিশুদের জানার, খেলার, জ্ঞানার্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। চার দেয়ালের এই বন্দিদশার সময় শিশুদের কিছু বিনোদন ক্ষেত্র তৈরী করে দিলে অনেক শিশুই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিবে বা মানিয়ে নিবে। মনে রাখতে হবে পুরো বিশ্বে করোনার কারণে আমরাও শতাব্দীর ভয়াবহতম সময় কাটাচ্ছি। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে তাল মিলিয়ে, পরিবারের সাথে সুন্দর জিনিস গুলো পুঁজি করে, আমরা পারি প্রযুক্তির সহায়তায় এমনকি ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়গুলো মিলিয়ে এ সময়টাতে শিশুদের সাথে সময় কাটানোর উপায় ও সুযোগ খুঁজতে হবে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করতে হবে সময় ও বয়স উপযোগী প্রতি দিনের রুটিন। নিজে খাবারের সময় শিশুকে সাথে নিয়ে খাবার খাওয়া, গল্প-ছড়ার বই পড়া, টিভি দেখা, লুডু বা কেরাম খেলা, ব্যায়াম করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, গোসল করারমত কাজগুলো করা যায়। এ সময় শিশুদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী নামাজ বা প্রার্থনার অভ্যাস করা খুবই ভালো দিক হতে পারে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি সৃজনশীল কর্মকান্ড যেমন চিত্রায়ণ, গানের বা কবিতার চর্চা, ব্যায়াম বা শিশুর পছন্দ অনুযায়ী অন্য কিছু। রাতে আবার পাঠ্যবই পড়া, নিউজ দেখা, শিশুদের শিক্ষা মূলক কার্টুন দেখানো, ইতিহাস বা রহস্য কাহিনি শোনানো, টেলিভিশনে খবর দেখা, ডিনার করা, ব্রাশ করা, হাত ধোয়া, বিছানা তৈরি করা, মশারি টানানো, পানি খাওয়ার মতো অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। এছাড়া নিয়মিত পাঠ সম্পূর্ন করার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে শিশুর খাদ্যাভ্যাস বা ইমিউন সিস্টেম ডেভেলপ করতে পরিবারের রাখতে হবে একটি সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য পরিকল্পনা।
খাদ্যতালিকা :
করোনার বন্দি এ সময়ে শিশুর খাদ্য তালিকা হতে হবে পুষ্টিকর। বিশেষ করে পুষ্টিকর তেল, ফাস্টফুড জাতীয় খাবারের বিপরীতে ঘরে তৈরি খাবার দিবেন। হতে পারে সকালের নাশতায় ডিম, রুটি-সবজি বা দু-তিন ধরনের ডাল মিলিয়ে খিচুড়ি। সকাল দুপুরের মাঝখানে লেবু, আমলকী বা ফলের জুস, বাদাম, গাজর, শসা। দুপুরে মাছ বা মাংস, ডাল, কালোজিরা ভর্তা, সাদা ভাত। বিকেলে মসলা ছাড়া হালকা নাশতা, থাকতে পারে আদা বা লেবু মিশ্রিত রং চা। রাতে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে এক কাপ দুধ থাকলে ভালো। ভালো হয় পরিচিত শিশু ডাক্তার বা পুষ্টিবিদ থাকলে তাদের সহায়তায় ভিটামিন ও পুষ্টিমান খাবার বিতরণ করা।
ব্যায়াম :
এই সময়ে শিশুর বুদ্ধি বিকাশে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যায়ামের বিকল্প নাই। অনলাইনে সার্চ দিলে শিশুদের ব্যায়ামের অনেক টপিক পেয়ে যাবেন। মনে রাখবেন আপনার সাথে শিশুকে ব্যায়াম করালে শিশুর মানুষিক বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। ব্যায়ামের সাথে নিয়মিত ঘুম শিশুর জন্য এ সময়ে খুবই উপকারী। মনে রাখবেন নিয়মিত ঘুম, সময়মতো খাওয়া আপনার ও শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক স্বাস্থ্য: শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যর মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য। মনে রাখবেন, শিশুরা ছোট হলেও মনস্তরের দিক থেকে তারা আমাদের মতোই পূর্ণাঙ্গ। তাদেরও চিন্তা হয়, হয় টেনশন ও ডিপ্রেশন। আমাদের মতো প্রকাশ করতে পারে না। এই সংকটকালে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই নির্ভর করছে পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক মানসিকতার ওপর। দিশাহীন, অবরুদ্ধ এই শিশুদের মনভুবনের পুরো অংশজুড়ে আছে পরিবার। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক নির্দেশিকায় শিশুর জন্য ভয় ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশ তৈরির কথা জানানো হয়েছে। শিশুকে নিজেদের সঙ্গে রেখে সদাচরণ করার প্রতি জোর দিয়েছে সংস্থাটি। শিশুদের অযাচিত চিন্তা থেকে দূরে রেখে, পারিবারিক রুটিন অনুসরণ করে অতিরিক্ত পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের বোঝা না চাপিয়ে খেলাধুলা বা অঙ্কনের মতো সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। আর এ রকম সংকটকালীন মুহূর্তে শিশুরা যেহেতু পিতা-মাতার অতিরিক্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবে, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। যেসব শিশু কোভিড-১৯ এর বিষয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন, তাদের বয়স উপযোগী তথ্যগুলো সততার সঙ্গে জানিয়ে বাস্তবতা মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এনেছে, তা হলো শিশুর আচরণগত পরিবর্তন। যেহেতু শিশুরা এ সময় বড়দের আচরণ ও আবেগ, অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং তাদের আবেগগুলো ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে, তাই বড়দের মানসিক স্বাস্থ্যও এই সংকটকালে ইতিবাচক থাকা জরুরি।
খেলাধুলা :
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একদল মনোবিদের মতে, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে খেলাধুলা অত্যন্ত কার্যকরী। এ ক্ষেত্রে ইনডোর গেম (লুডু, দাবা, ক্যারম, ভারসাম্য দৌড়, বল নিক্ষেপ ইত্যাদি), জ্ঞানানুশীলনমূলক খেলা (শব্দজট, কোনো বিষয় নির্ধারণ করে বলা, কুইজ, রাইমিং শব্দ তৈরি, যোগ-বিয়োগের খেলা ইত্যাদি)। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে এসো নিজে করি এর আওতায় খেলার ছলে নানা শিক্ষণীয় বিষয় শেখানো। এ ক্ষেত্রে শিক্ষামূলক অনলাইনভিত্তিক টিউটরিয়াল থেকে পেতে পারেন বয়স উপযোগী ইনোভেটিভ আইডিয়া।
শিশুদের কথাটা শুনুন :
শিশুদের আনন্দে রাখতে ওদের মনের কথাটা শুনুন ও সময় দিন। যোগাযোগ বিছিন্ন না রেখে তাদেরও সামাজিক যোগাযোগ করার সুযোগ করে দিন। তাই সম্ভব হলে অনলাইনে প্রিয় শিক্ষক, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বা ফ্যামিলি গ্রুপ তৈরি করে শিশুদের দাদা-দাদি, নানা-নানি, কাকা-মামা বা কাজিনদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দিন। গ্রুপে তথ্যভিত্তিক লেখা বা পারিবারিক গল্প, মজার মজার শিক্ষামূলক ভিডিও, প্রতিদিন কে কী করছেন, কীভাবে আছেন, জানার সুযোগ তৈরি করে দিন।
অধ্যাপক (ডাঃ ) মনজুর হোসাইন
শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
সাবেক পরিচালক, শিশু হাসপাতাল
ডাঃ মনজুর’স চাইল্ড’স কেয়ার সেন্টার
৮৪/১(৩য়তলা), রোড ৭/এ, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা- ১২০৯ ।
মোবাইল-০১৭১১৪২৯৩৭৩
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন