বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মানুষের কৃৃৃতকর্মই করোনা মহামারি ডেকে এনেছে

মো. আমিনুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

মানুষের আবাসভূমি এই পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ ভাইরাস ও জীবাণু উপস্থিত। মানবদেহের অভ্যন্তরেও রয়েছে অগণিত ভাইরাস। এগুলোর মধ্যে কিছু আছে প্রাণঘাতী, কিছু আছে উপকারী। এদের অনেকগুলো খালি চোখে দেখা যায় না এবং কোনকোনটি এখনও আবিষ্কারও করা সম্ভব হয়নি। আলকোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার মালিকের (বিশাল) বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।’ সূরা আল মুদ্দাস্সির: ৩১। আল্লাহই এদের নিয়ন্ত্রণ করেন। জলে-স্থলে, আসমান-জমিনের সবকিছুই মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর একক কর্তৃত্বে পরিচালিত। তিনি পৃথিবীর কিছু জিনিস মানুষের ব্যবহরের জন্য তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করেছেন। কিন্তু এরা সবাই আল্লাহর অনুগত বাহিনী। প্রতিটি অণু-পরমাণুর উপর রয়েছে আল্লাহর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনী আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ সূরা আল ফাত্হ: ৭।

মানুষের হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। সুস্পষ্ট উপদেশ কোরআন নাযিল করেছেন। ওয়ারিছাতুল আম্বিয়াগণ অসৎ, অপকর্ম, পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে সুশীল, পরিশুদ্ধ ও কল্যাণকর জীবনযাপন করার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। এতকিছুর পরও যখন মানুষ অন্যায় করে, অশ্লীলতা ছড়ায়, ব্যাভিচার করে, জুলুম-নির্যাতন করে, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ বাঁধায়, অন্যের অধিকার হরণ করে এবং খোদাদ্রোহী হয়ে জলে স্থলে বিভিন্ন বিপর্যয় সৃষ্টি করে নৈতিক অবক্ষয়ের অতল গহবরে নিমজ্জিত হয়, তখনই আল্লাহ বিভিন্ন জাতিকে সতর্ক করেন, বিপদ মুসিবত দেন, মহামারি দিয়ে তাদেরকে বিপর্যস্ত করেন। সেই আদিকাল থেকে প্লেগ, ব্লাক ডেথ, স্মল পক্স, গ্রেট প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর, গুটিবসন্ত, স্প্যনিশ ফ্লু, সার্স, সোয়াইন ফ্লু, জিকা ভাইরাস, ইবোলা, বর্তমানে কোভিড-১৯, এভাবে বিভিন্ন শতাব্দিতে কোন না কোন মহামারি ছিল পৃথিবীর সংসর্গী। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি লক্ষ করে না যে, তারা প্রতিবছর একবার অথবা দুইবার কোন না কোন বিপদে পতিত হয়। তবুও তারা তওবা করেনা, আর না তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ সূরা আত তাওবা: ১২৬। আদ, সামুদ, বনী ইসরাঈলসহ বিভিন্ন জাতির উপর আল্লাহ কী ধরনের বিপদ মুসিবত নাযিল করেছেন ইতিহাস তার সাক্ষী। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি তাদের উপর ঝড় তুফান, পংগপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত (-পাত জনিত বিপর্যয়) পাঠালাম, এসবই সুস্পষ্ট নিদর্শন; কিন্তু তারা অহংকার বড়াই করতে থাকল, আসলেই তারা ছিল অপরাধী জাতি।’ সূরা আল আ’রাফ: ১৩৩। এসব বিপর্যয়ের হয়তো কিছু প্রাকৃতিক কারণ ও ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু নৈতিক অনুভূতি হচ্ছে এগুলো আল্লাহর অবাধ্যতার পুরস্কার! এ উপলব্ধির অত্যুক্তি হবে না যে আজ বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনার যে সংক্রমণ ও বিভিন্ন বিপর্যয় এ সবই মানুষের কুকর্মের ফল ও সর্বনাশা অপরাধের অনিবার্য পরিণতি।

জ্ঞান বুদ্ধির দিক থেকে মানুষ অন্য প্রাণীকূল থেকে উৎকৃষ্ট। মানুষ বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শুধু মনুষ্য সমাজেই নয়, জীব-জন্তু, প্রকৃতিতেও বিভিন্ন বিপর্যয় সংঘটিত করছে। পাহাড় কেটে ও নদীতে অবৈধ বাঁধ দিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস ও বিপন্ন করছে। মরণঘাতী রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে পানি দূষিত করছে। পশু পাখির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। সুন্দরবন ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে, বিশ্বের বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট আমাজান পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়েছে কোটি কোটি গাছপালা ও প্রাণীকুল। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ০৫.৮ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমিতে আগুন লাগানো হয়েছে। এভাবে বনভূমি উজাড় করে কার্বন নিঃসরনের মাত্রা বাড়িয়ে বায়ুমন্ডলের নিরাপত্তা স্তর ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় ডেকে আনছে। অর্থনৈতিক স্বার্থে এসব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানো, ফরমালিনের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ, দ্রব্যসামগ্রী নকল করা ইত্যাদি তো আছেই। করোনার সংকট মুহূর্তেও অসাধুচক্র নকল করোনা সনদ, পরীক্ষায় জালিয়াতি এবং অক্সিজেন, ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর মূল্য অনৈতিকভাবে বৃদ্ধিকরে দূর্ভোগকে আরো বৃদ্ধি করছে। এভাবে মানুষ নিজেকে কলুষিত করছে এবং মাটি, পানি, বায়ু ও এর অভ্যন্তরের সব কিছু দূষিত ও জনপদকে স্বাপদ-সংকুল করছে। আজ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের চরিত্র ও কর্ম প্রাণীকূলের থেকে অধম। আর শাসকগণের কেউ কেউ হালাকুখান, চেঙ্গিস বা হিটলার এর চেয়ে ভয়ংকর। কিছুদিন হলো মিয়ানমার মুসলমানদের জীবন্ত পুড়িয়ে, হাত-পা কেটে মেরেছে। ঘরছাড়া করে নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে, দেশ ছাড়া করেছে। কাশ্মিরে মহিলাদেরকে সন্তানদের সামনে গণহারে শ্লীলতা হানি করেছে। দীর্ঘদিন ঘরে লকডাউন করে নির্যাতন করেছে। বিশ্ব কি এসবের প্রতিবাদ করেছে? শুধুমাত্র অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রতিপক্ষকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য কত আকামই না করা হয়। আজ অত্যাচারের কাছে ন্যায়বিচার বশীভূত, দয়া নিষ্ঠুরতার কাছে, সততা দুর্নীতির কাছে, জ্ঞানবুদ্ধি মূর্খতার কাছে পরাভূত হচ্ছে। এ সমস্ত অপরাধের কি বিচার হবে না!

এতসব বিপর্যয় দেখে প্রাণীকূল আজ মানুষের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছে। পাহাড়, পর্বত, গাছ-পালা, পশু-পাখি, গ্রহ-নক্ষত্র, মেঘমালা, বায়ু সব কিছুই আল্লাহ তা’আলার গুণগান করে। আল্লাহ বলেন ‘সাত আসমান, জমিন, এবং এ (দু’য়ের) মাঝখানে যা কিছু আছে তা সবই তার পবিত্রতা ও মহিমা করছে, (সৃষ্টিলোকে) কোনো একটি জিনিস এমন নেই, যা তার প্রশংসা পবিত্রতা ও মহাত্ম ঘোষনা করেনা।’ সূরা বনী ইসরাইল: ৪৪। মানবজাতির সর্বগ্রাসী ঔদ্ধত্য ও অপকর্ম আজ প্রকৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাদের আল্লাহর গুণগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। আর তাই তাদের কষ্ট ও অভিযোগ আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফলে, এই বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ প্রকৃতির অভিশাপ, মানুষের হাতের কামাই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ সূরা আর রুম: ৪১। মানুষ তাদের অজ্ঞতা, মূর্খতা, হিংসা ও লোভের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন ভাবে এই পৃথিবীকে ভারসাম্যহীন করছে। এর অনিবার্য ফল এই মহামারী। আজ মানুষে মানুষে, সমাজে ও দেশে দেশে যে বিষবৃক্ষের জন্ম হয়েছে তার শিকড় অনেক গভীরে প্রথিত। নৈতিক সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয় পরস্পর এর মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। মানুষ দীর্ঘদিন শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। একান্ত নিজের স্বার্থে ও সুখের জন্য অপরকে ধ্বংস করতে পর্যন্ত পিছপা হয়নি। মানুষ তার দায়বদ্ধতা থেকে বহু আগেই অনেক দূরে সরে গেছে। প্রতিফল হলো আজ আপনজন মরে গেলেও তার লাশটি পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখতে পারছে না। বাপ ছেলেকে ফেলে, ছেলে বাপকে ফেলে চলে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় প্রাকৃতিক প্রতিশোধ আর কি হতে পারে?
লেখক: ব্যাংকার, ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন