ঢাকা শহরকে একটি আধুনিক বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় প্রতিটি সরকারই ঢাকাকে ঘিরে নগরবাসীকে রোমাঞ্চকর স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ফ্লাইওভার, বিআরটি, মেট্রোরেল প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হলেও একটি সুপরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ে তোলার অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে কার্যকর নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব সরকারই ব্যর্থ হয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ রাজধানী নগরী দীর্ঘদিন ধরেই যানজট, আবাসন, স্যুয়ারেজ, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানির লাইন ইত্যাদি নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই নব্বই দশকের শুরুর দিকে ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান (ড্যাপ) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর ইতোমধ্যে প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেলেও তা আজও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বিভিন্ন সময়ে প্রভাবশালী মহলের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের জালে জড়িয়ে ড্যাপকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে খোদ ড্যাপ বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেই। সময় গড়িয়ে যায়, ড্যাপ বাস্তবায়নে নগরবাসীর মধ্যে যখন এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়, তখনি হঠাৎ করে নতুন ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে আলোচনায় উঠে আসে ড্যাপ।
গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সভায় ড্যাপ বাস্তবায়নের জন্য আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে একটি অ্যাকশন প্লান তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন এ সংক্রান্ত কমিটির প্রধান স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী। এছাড়া ড্যাপের ভূমি ব্যাবহার পুনর্বিবেচনা সংক্রান্ত আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি সচিব কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং রাজধানীর খাল ও চারপাশের নদীগুলো জরুরি ভিত্তিতে খনন করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় খোদ রাজউক কর্তৃক ড্যাপ সংশোধনে ৪ সুপারিশের বিরুদ্ধে এলজিআরডি মন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ১৯৯৫ সালে গৃহীত ড্যাপ ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মূল্যায়ন এবং গণশুনানির মধ্য দিয়ে একটি চূড়ান্ত অবস্থান লাভ করেছিল। গত বছর সেপ্টেম্বরে একটি জাতীয় সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গৃহায়নমন্ত্রী বলেছিলেন, ঘরে বসে লাইন টেনে ড্যাপ করলে হবে না, সমন্বিতভাবে বাস্তবসম্মত ড্যাপ ও স্ট্রাকচারাল প্লান তৈরি করতে হবে। এজন্য তিনি ড্যাপ চূড়ান্তকরণে আরো এক বছর সময় লাগবে বলেও উল্লেখ করেছিলেন। গত এক বছরে ড্যাপ পরিবর্তনে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা না গেলেও ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ৯ম বৈঠকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে এবং স্বল্প সময়ে অ্যাকশন প্লান তৈরির যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়।
মোগল ও ব্রিটিশ আমলে ঢাকাকে একটি গার্ডেন সিটি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা প্রথম ডিআইটি প্ল্যানও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় অপরিকল্পিতভাবেই বেড়ে উঠেছে ঢাকা। প্রায় দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবে তালিকাভুক্ত। আমরা যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছি, আগামী দশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, তখন আমাদের রাজধানী শহর বিশ্বের সবচেয়ে, অপরিচ্ছন্ন, অনিরাপদ ও সমস্যাসঙ্কুল শহর হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এ কথা সত্য যে, আমাদের সামাজিক ও নাগরিক বাস্তবতা ইউরোপ-আমেরিকার মতো নয়। অধিক জনসংখ্যা এবং ইতোমধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নগরীর বাস্তবতা মেনে নিয়েই ঢাকার জন্য সমন্বিত ও বাস্তবসম্মত এরিয়া ও স্ট্রাকচারাল নকশা এবং গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। আগামী ১০০ বছরের সম্ভাব্য ডেমোগ্রাফি এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই ড্যাপ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। ড্যাপে জমির প্রকৃতি পরিবর্তনে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রশ্নে আপস করা চলবে না। খাল পুনরুদ্ধার, জলাধার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা পরিহারে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তনের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। বুড়িগঙ্গাসহ চারনদীর বেদখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের স্থায়ী উদ্যোগ প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মের জন্য ঢাকাকে নিরাপদ, গতিশীল, পরিবেশবান্ধব ও বাসযোগ্য আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ড্যাপ বাস্তবায়নে আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন