দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার এখন পানিবন্দি, লক্ষাধিক হেক্টর আমন ধানের জমি পানিতে ডুবে গেছে। এখন বানভাসি মানুষের মধ্যে আশ্রয়, খাদ্য, পানীয় ও জরুরী চিকিৎসা সেবার জন্য হাহাকার দেখা গেলেও সেদিকে কারোই যেন মনোযোগ নেই। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বশক্তি ও মনোযোগ যেন জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান ও ব্লেইম গেমে নিয়োজিত রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় দেশের উপর বড় ধরনের সমস্যা চেপে বসার আশঙ্কা ও আলামত দেখা যাচ্ছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং জননিরাপত্তায় সরকারী বাহিনীগুলো সম্ভাব্য সব ধরনের উপায় অবলম্বন করার পরও দেশের সাধারণ মানুষ এবং বিদেশী নাগরিকরা আস্থা রাখতে পারছে না। বিদেশীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে বলে তাদের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক এবং বাংলাদেশে আসার সিডিউল বাতিলের ধারাবাহিক তৎপরতা থেকে বোঝা যায়। গুলশানে জঙ্গিবাদী হামলায় বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন অংশীদার জাপানের ৭ নাগরিক নিহত হওয়া বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটিয়েছে। যদিও জাপানের তরফ থেকে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তথাপি পারিপার্শ্বিক আলামত খুব সুখকর নয়। গত ২৪ জুলাই বহু প্রতীক্ষিত এবং সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্টের বিডিং চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও অনাকাক্সিক্ষত ভাবে তা’ স্থগিত হয়ে গেছে। জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকা প্রধানের বাংলাদেশ সফরটিও হঠাৎ করে বাতিল হয়ে গেছে। এতে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও নেতিবাচক প্রবণতাই ফুটে ওঠে।
গুলশানে জঙ্গি হামলার আগে থেকেই দেশের তৈরী পোশাক রফতানী খাতের ক্রেতাদের অনেকে বাংলাদেশে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদের সফরসূচি বাতিল করে। বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য বিশেষ সতর্কতা জারি করে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কোন কোন দেশ বাংলাদেশে তাদের কার্গো উড্ডয়ন বন্ধ করে দেয়। গুলশান ঘটনার পর বিদেশীদের আশ্বস্ত করতে এবং আস্থা অর্জনে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সম্ভাব্য সব কিছুই করছে। সরকারের এসব উদ্যোগ দেশের সাধারণ মানুষ অথবা বিদেশীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে হচ্ছেনা। উপরন্তু বিভিন্ন বাহিনীর জঙ্গিবাদ বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানসহ নানা ধরনের উচ্ছেদ ও নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত একদিকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করছে, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকা-ে জনমনে আরো বেশী ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এখন আর কোন দেশের একক সমস্যা নয়, এটি এখন অবিচ্ছিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আত্মঘাতী বা চোরাগোপ্তা হামলার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে চরম ভীতি ছড়িয়ে দেয়াই জঙ্গিদের মূল লক্ষ্য। এ কারণে জনগণের ভীতি প্রশমন করে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নিরাপত্তা ও আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ। বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সে ধরনের কৌশলগত ভূমিকা অপ্রতুল। গুলশানে হামলায় নিহতদের মধ্যে ৯জন ইতালীয় ছিলেন। ইতালীয়দের প্রায় সবাই ইউরোপে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানীর সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। বিদেশী নাগরিকরা জঙ্গি হামলার টার্গেট হওয়ায় রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ২৬বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাক রফতানীখাতে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। রয়টার্সের এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় আমাদের সরকার এবং তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা আশার বাণী শোনালেও দীর্ঘ মেয়াদে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা।
গত কয়েক সপ্তাহে গুলশান বনানীর হোটেল রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়সহ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরাসহ বাড়তি নজরদারি আরোপের পরও গত একমাসে জীবনযাত্রায় স্বাভাবিক গতিশীলতা আসেনি। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের কবলে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে বিপর্যয় তৈরী হয়েছে সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদীরা বাংলাদেশে তারই বাস্তবায়ন ঘটাতে চাইছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন বাংলাদেশে তা’ দেখা যাচ্ছেনা। বরং দোষারোপের রাজনীতিটাই প্রবল। অসহিষ্ণু ও সংঘাতময় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর আশঙ্কার কথা প্রকাশ করছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। আমাদের সরকার এসব আশঙ্কাকে কোন গুরুত্ব দেয়নি বলেই মনে হয়। এখনো সরকার শুধুমাত্র পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সোয়াত দিয়েই জঙ্গিবাদের সমস্যা নির্মূল করতে আগ্রহী। সারাদেশের মানুষ যখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তখনো সরকার এবং বিরোধীদল ব্লেইম গেমে লিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক ময়দান ছাড়াও জনগণের মতামত এখন নানাভাবেই প্রকাশিত হয়। দেশের নতুন প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবলভাবে সক্রিয় রয়েছে। তাদের বেশীরভাগই দলকানা নয়। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের জঙ্গি হামলায় নিজেদের ৭ বিশেষজ্ঞকে হারিয়েও জাপান সরকার বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। জাপানী প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আঘাতকে পুরো এশিয়ায় আঘাতের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভেদ নিরসনে সরকার উদাসীনতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে। অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ বাংলাদেশ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও হুমকি। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অসহিষ্ণুতা এবং অনিশ্চয়তাকে পুঁজি করে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা তৎপরতার সুযোগ পাচ্ছে। ভয়াবহ সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সব ভেদাভেদ ভুলে সংশ্লিষ্ট সকলকে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন