দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাটের আবাদ বাড়লেও আকস্মিকভাবে সরকারী পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের সাথে বন্যার কারণে কাঁচা পাটের দাম নিয়ে শঙ্কিত কৃষকরা। গতবছর দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন হাট বাজারে যেখানে প্রতিমন পাট দু হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার সেখানে কৃষকরা তা আরো দুশ টাকা বেশী আশায় আবাদ করেছিল। কিন্তু দাম এখনো আগের অবস্থানেই। মূলত করোনা সংক্রমণের মধ্যেই আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রয়ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরূপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে কাঁচা পাটের বাজারে। ইতোমধ্যে বৃহত্বর বরিশাল ও ফরিদপুরের ১১টি জেলার প্রায় ৬৫ ভাগ পাট কাটা শেষ হয়েছে। কিন্তু পাটকল বন্ধ সাথে বণ্যার কারনে পাট নিয়ে চরম বিপাকে ফরিদপুর, রাজবাড়ী মাদারীপুর ও শরিয়তপুরের পাট চাষিরা।
গত বছর দক্ষিণাঞ্চরেল ১১ জেলায় ২ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৪৬ লাখ টনের মত পাট উৎপাদন হয়েছিল। প্রতিমন পাটের দর ছিল ১ হাজার ৮শ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। এবার ভাল দামের আশায় কৃষকরা কোমড় বেঁধে মাঠে নেমেছিল। চলতি মৌশুমে এ অঞ্চলে ২ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ স্থির করেছিল কৃষি মন্ত্রনালয়। এরমধ্যে বৃহত্বর ফরিদপুর অঞ্চলে ২ লাখ ২১ হাজার হেক্টর এবং বরিশাল অঞ্চলে আরো প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর পাট আবাদের লক্ষ ছিল। ফরিদপুর অঞ্চলে প্রায় ২ লাখ ১৯ হাজার হেক্টরে এবং বরিশাল অঞ্চলে ১৫ হাজার হেক্টরে পাটের আবাদ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই’র মতে এবার দক্ষিণাঞ্চলে পাটের উৎপাদন লক্ষ রয়েছে প্রায় ৫৩ লাখ টনেরও বেশী। সারা দেশে উৎপাদিত পাটের একটি বড় অংশই আবাদ ও উৎপাদন হয়ে থাকে দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্বর ফরিদপুরে। ডিএই’র মতে দেশে বর্তমানে যে প্রায় ৮ লাখ হেক্টরে পাট আবাদ হয়, তার প্রায় ৩০%-ই হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। বর্তমানে প্রতি মন পাট উৎপাদন ব্যায় দেড় হাজার টাকারও বেশী। কিন্তু প্রায় সাড়ে ৪ মাসের সাধনার এ ফসল আবাদ ও উৎপাদন থেকে বিক্রী করা পর্যন্ত মুনফা তুলতে হলে দু হাজার ২শ টাকার ওপরে নিট মূল্য পাওয়া জরুরী বলে মনে করছেন কৃষকগন।
কিন্তু বণ্যা ফরিদপুর অঞ্চলের জেলাগুলোর পাটকে যেমনি গ্রাস করছে, অপরদিকে পাটকল বন্ধের কারনে বাজারে ভাল দামের আশাও ক্রমশ নিভু নিভু। তবে বেসরকারী পাটকলগুলো ইতোমধ্যে ফরিদপুর, রাজবাড়ী সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাট কিনতে শুরু করলেও দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নয় কৃষকগন। পাট নির্ভর বৃহত্বর ফরিদপুরে বেসরকারী খাতের ১৯টি পাটকলের সচল রয়েছে ১৩টি। বরিশাল অঞ্চলে ছোট ও মাঝারী মাপের আরো ৫টি পাটকল থাকলেও সবগুলোই চলতি মুলধন ও মেশিনারি আধুনিকায়নের অভাবে অচল। বেসরকারী খাতে দেশের অন্যতম বৃহত করিম জুট মিল ও পারটেক্স গ্রæপের পাটকলও ফরিদপুর অঞ্চলে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, দেশে পাট চাষির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ হলেও এখাতের ওপর নির্ভিরশীলের মোট সংখ্যাটা ৪০ লাখের কাছে। আর জিডিপি’তে পাটের অবদান ০.২৬% হলেও কৃষি সেক্টরে একক অবদান ১.১৪%। দেশে বর্তমানে কমবেশী ৮লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে।
গত কয়েক বছর ধরে ধানের দাম কম থাকায় কৃষকরা পাট আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠলেও সেখানেও এবার বিরূপ পরিস্থিতি সরকারী পাটকল বন্ধের আকষ্মিক সিদ্ধান্তে। সরকার যদিও পিপিপি পদ্ধতিতে বন্ধ কলগুলো সচল করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সে ধরনের কোন বাস্তব উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান না হওয়ায় পাটের বাজারে বিরূপ পরিস্থিতি। ডিএই’র তথ্যনুযায়ী দেশে উৎপাদিত পাটের ৫১% স্থানীয় পাটকলে ব্যবহৃত হয়। ৪৪% কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তনি হয়ে থাকে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, গত অর্থ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে দেশের আয় ছিল ৮৮ কোটি ডলারেরও বেশী। যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে প্রায় ৮% বেশী। এ আয়ের সিংহভাগই এসছে পাটসুতা বা জুট ইয়ার্ন থেকে। কাঁচাপাট রপ্তানিতে আয় ছিল ১ কোটি ডলার, যা মোট পাটজাত পন্যের ১৫%। এসময়ে পাটের বস্তা ও চট রপ্তানি করেও আয় ছিল ১০.৬৫ কোটি ডলারের। প্রবৃদ্ধি ছিল ২৮.৫০%-এর বেশী। এছাড়া বিভিন্ন পাটজাত পণ্য রপ্তানিতেও আয় ছিল প্রায় ২০ কোটি ডালার। ফলে দীর্ঘদিন পরে পাটজাত পণ্য রপ্তানি চামড়াজাত পণ্যকে ছাড়িয়ে যায়।
অপরদিকে পরিবশেবীদদের মতে, পাটের আবাদ কমলে গ্রাম বাংলায় জ¦ালানি সংকট সৃষ্টির আশংকা দেখা দিতে পারে। মানুষ পাটকাঠির বিকল্প হিসেব গাছপালা কেটে জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহারে ঝুকে পড়লে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন