বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস সি

| প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে। জন্ডিস বলে যে রোগকে চিহ্নিত করা হয় তার মধ্যে অন্যতম এই ভাইরাসটি। তবে একথা সত্যি যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে হেপাটাইটিস এ ও বি ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করার টীকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। মানুষও এই রোগের ব্যাপারে আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন। ফলে টীকা গ্রহনের মাধ্যমে এই দুই ধরনের হেপাটাইটিসকে কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করতে পেরেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। হেপাসাইটিস এ-র তুলনায় হেপাটাইটিস বি বেশি ক্ষতিকারক হলেও আজ এই রোগ আর মরণ রোগ হিসাবে বিবেচিত হয় না। জানিয়ে রাখা ভালো, লিভার বা যকৃতের এক ধরনের প্রদাহ জনিত অসুখই হল হেপাটাইটিস।

বর্তমানে হেপাটাইটিস আরো মারাত্মক আকারে বাসা বাঁধছে মানব শরীরে। নতুন নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হেপাটাইটিস সি। বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে এই রোগ। কারণ এই রোগের টীকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। এমনকি হেপাটাইটিস সি-এর চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে তাও যে সব রোগীর কাজে লাগে এমনটা নয়। যে সমস্ত রোগী ওই ওষুধে সাড়া দেন, তাদের আবার ওষুধ কিনতে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে প্রতি সপ্তাহে একবার পিজিলেটেড ইন্টারফেরন নামের একটি ইনজেকশন দিতে হবে, টানা একবছর। অর্থাৎ ৫২ সপ্তাহ ধরে চলবে এই চিকিৎসা। সঙ্গে রাইবাভিরিন নামের আরেকটি ওষুধ। প্রতিটি ইনজেকশনের দাম ১৮ হাজার থেকে ২০ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের নেই। গরিব মানুষের পক্ষে এই চিকিৎসার বোঝা বহন করা সম্ভবও নয়।

পর্দার অন্তরালেই বেড়ে উঠে এই রোগী। অতীতে এই রোগ সম্পর্কে কোনো ধারণা আমাদের ছিল না। ১৯৮৯ সালের আগে কেউ হেপাটাইটিস সি-র নামই শোনেনি। বর্তমানে ১৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস সি এ আক্রান্ত বিশ্বজুড়ে। এই তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। হেপাটাইটিস সি মরণ রোগ হিসাবেই চিহ্নিত। সচেতনতার অভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে এক শরীর থেকে আরেক শরীরে। অনেকটা ঠিক এইচআইভির মতো। ব্লাড ট্রান্সফিউশন, ইনজেকশনের সূঁচ, নিরাপদ নয় এমন যৌন সম্পর্ক এই রোগের জন্য দায়ী। সন্তান প্রসবা যদি হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে নবজাতকেরও এই রোগ হতে পারে। তবে সমীক্ষা বলছে এক্ষেত্রে ৫ শতাংশ শিশু আক্রান্ত হতে পারে। আর মা যদি এর সঙ্গে শরীরে এইচআইভি-ও বহন করে, সেক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ ক্ষেত্রে তার সন্তানের হেপাটাইটিস সি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হেপাটাইটিস সি রোগে সবসময় চোখ হলুদ হবে এমনটা নয়। মাত্র ১৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে চোখ হলুদ হয়। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীকে দেখে হেপাটাইটিস সি নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। হেপাটাইটিস বি-র তুলনায় এই রোগ অনেক বেশি ক্ষতিকারক। হেপাটাইটিস সি-র জীবাণু দীর্ঘস্থায়ী হিসাবে আক্রান্তের শরীরে থেকে যায়। সেখান থেকে পরবর্তীকালে সিরোসিস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। আবার যারা সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যে বছরে ৪ শতাংশের লিভার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় হেপাটাইটিস সি আসলে নীরব ঘাতক হিসাবেই চিহ্নিত।

প্রাথমিকভাবে রক্তের লিভার ফাংশন টেস্ট, অন্টি এইচসিভি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয় রোগ চিহ্নিত করার জন্য। রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হলে পরবর্তীতে এইচসিভি আর এন এ পরীক্ষা করে দেখা হয় যে এই রোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরে কতটা বিস্তার লাভ করেছে। একইসঙ্গে এইচসিভি-জেনোটাইপ পরীক্ষা করলে রোগ কোন স্তরে আছে সেই চিত্রও সামনে চলে আসে। ফলে চিকিৎসা করতে সুবিধা হয় ডাক্তারদের। যদি দেখা যায় রোগী জেনোটাইপ-১ স্তরে আছে, সেক্ষেত্রে রোগীর পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। ৩০-৪০ শতাংশ রোগীকে দীর্ঘ চিকিৎসার পর হয়ত সুস্থ করা সম্ভব হয়। তবে রোগী জেনোটাইপ-২ স্তরে থাকলে ৭০ শতাংশ রোগীকে পুনরায় স্বাভাবিক করে তোলা যেতে পারে। উল্লেখ্য, রোগীর জন্ডিসের ইতিহাস না-থাকলেও হেপাটাইটিস সি হতে পারে। ফলে রোগ প্রতিরোধের আগে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। সরকারেরই এ ব্যাপারে মুখ্য উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সরকার যেমন উদ্যোগী, হেপাটাইটিস সি সম্পর্কেও সমান উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন