মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাংলাদেশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় পিছিয়ে

করোনা ভ্যাকসিন চীনে কার্যকর হলে বাংলাদেশ আগে পাবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব। ভাইরাসটি গোটা বিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই অদৃশ্য ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিস্কারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের সেরা সেরা বিজ্ঞানীরা টিকা আবিস্কারের চেষ্টা করছেন। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন, চীনের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন, আমেরিকার মডার্নারের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে। রাশিয়াও ভ্যাকসিন উদ্ধাবন করেছে।

সবার আগে চীনের সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করে বাংলাদেশে তৃতীয় দফা ট্রায়ালের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) অনুমোদনও দেয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সে পরীক্ষা বিলম্বিত করা হয়। ফলে করোনার টিকা পেতে দক্ষিণ এশিয়া তথা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও এখন কার্যত পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন চীনের ভ্যাকসিন তৃতীয় দফা পরীক্ষামূলক ব্যবহার করছে; তখন বাংলাদেশ কেন তা করা থেকে বিরত থাকলো? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক কারণেই চীনের ভ্যাকসিন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত থেকে বাংলাদেশ সরে এসেছে। কারণ ভারত অখুশি হয় সে জন্যই সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন পরীক্ষা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার লাল ফিতায় আটকে যায়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জহিদ মালেক কয়েক মাস আগেই টিকা আবিস্কার হলে সেটা যাতে আগে বাংলাদেশ পায় সে বিষয়েও কথা বলে রাখেন চীনের সঙ্গে। চীনের প্রতিনিধিরাও বলে গেছেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে গত ১৯ জুলাই চীনের সিনোভ্যাকের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি)। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থা-আইসিডিডিআর-বি’র তত্ত্বাবধানে এই পরীক্ষা হওয়ার কথা। অথচ ভারত তখনও করোনা চিকিৎসা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আর করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র প্রতিষেধক ভ্যাকসিন নিয়ে দ্রুত অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

একইভাবে গণস্বাস্থ্যের র‌্যাপিড কিটের ব্যবহারও থেমে গিয়েছিল। আর তাই চীনের টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালও হয়ে পড়ে বিলম্বিত। এ সময়ের মধ্যেই ভারত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির টিকা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়; দেশে সিনোভ্যাকের ট্রায়াল হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পেত। কিন্তু এখন নির্ভর করতে হবে ভারতের ওপর। কারণ টিকা তৈরির জন্য বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের থেকে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য পাচ্ছে ভারতের টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউট। ‘গ্যাভি’ হলো প্রাইভেট-পাবলিক সংস্থা, যারা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা সহজলভ্য করে তুলতে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য করে। এই অর্থের মাধ্যমে ভারত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১০ কোটি টিকা তৈরি হবে। নিজেরা তৈরি না করায় তাই পরবর্তীতে বাংলাদেশকে টিকা আনতে হবে ভারতের কাছ থেকে।

এদিকে বাংলাদেশ চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে না পারলেও ঠিকই আরব আমিরাত সিনোভ্যাকের ট্রায়াল করাচ্ছে। যদিও ভ্যাকসিন আগে পাওয়াই এখন সরকারের মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, বিশ্বের ২০০টিরও বেশি কোম্পানি করোনা ভ্যাকসিন আবিস্কারে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৪১টি কোম্পানি প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করছে এবং ২৫টি কোম্পানি এই ভ্যাকসিন মানব দেহে পরীক্ষারত পর্যায়ে রয়েছে। এসব কোম্পানির ভ্যাকসিনসমূহের সকল গুণাগুণ বিচার বিশ্লেষণ করে বাজারজাতের প্রথম পর্যায়ে এবং সবার আগে যেন বাংলাদেশ পায় সেটি নিশ্চিত করাই হবে সরকারের মূল লক্ষ্য।

ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। চীনের ভ্যাকসিনটি এদেশে ট্রায়ালের কথা থাকলেও তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশটির সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। ভ্যাকসিন নিয়ে পরামর্শক কমিটিতে কোনো আলোচনাও হয়নি বলে জানান কমিটির অন্যতম এক সদস্য। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন অতি দ্রুত ভ্যাকসিনের পেছনে ছোটা। ভ্যাকসিন তৈরির পরপরই যেন বাংলাদেশ তা হাতে পায়, সেজন্য প্রয়োজন এখন থেকেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া।

বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে আছে কি-না জানতে চাইলে জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর ট্রায়াল হচ্ছে। এতে অংশগ্রহণ করেছেন ব্রাজিলের ৫ হাজার, সাউথ আফ্রিকার ২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এটা কার্যকর প্রমাণ হলে তারাই আগে পাবেন। বৃটিশ সরকারও ৫ কোটি ডোজের চাহিদা দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে কম আয়ের দেশ হিসেবে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা দেখছেন তিনি।

তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মে মাসে ১০টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে। সেখানে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন, চীনের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন, আমেরিকার মডার্নারের ভ্যাকসিন রয়েছে। চীন ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন দুটোই ভালো। চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন দিয়েছিল বিএমআরসি। সেটা যদি খুব তাড়াতাড়ি শুরু হতো তাহলে বাংলাদেশ উপকৃত হতো। আমাদের এখানে ট্রায়াল হলে ভ্যাকসিনটির কার্যকরিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। আমাদের একটা দাবি সৃষ্টি হবে।

প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করে বলেন, দাবি করে যে ভ্যাকসিন আমরা পেতে পারি সেদিকে যাচ্ছি না। বিল গেটসের গ্যাভি ফাউন্ডেশনের ভিক্ষা করা ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে আছি। জাতীয় পরামর্শক কমিটির এ সদস্য বলেন, ভ্যাকসিন বিষয়ে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই হয়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, এখানে দু’টি বিষয়। একটি হচ্ছে আবিষ্কার এবং কারো সঙ্গে সহযোগী হওয়া। অন্যটি ম্যানুফেকচারিং। এসব বিষয়ে সম্পৃক্ত হলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। আমরা একটির সঙ্গেও নেই। যারা ভ্যাকসিন তৈরি করলো তারা দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করবে। তিনি জানান, বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য ক্রয়াদেশ বা অর্ডার দিয়ে রেখেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি চুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ওখানে বলা আছে ইক্যুইটেবল বা সবার প্রতি সুবিচার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাবে। তবে ভ্যাকসিন দাতা সংস্থাগুলো কিনে দেবে। তখন বিনা পয়সায় পেতে পারে বাংলাদেশ। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশ চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশীদার হলে সুবিধা পেতো। তখন অগ্রাধিকার থাকতো। কিন্তু এটা অনিশ্চিত দেখছি। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশ ভ্যাকসিন দৌঁড়ে অবশ্যই পিছিয়ে আছে।

এদিকে রাশিয়া ভ্যাকসিন নিয়ে রীতিমতো ‘চমক’ দেখাচ্ছে বলা যায়। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই টিকা অনুমোদন দেয়ার সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে দেশটি। আন্তর্জাতিক একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আগামী সপ্তাহেই কোভিড-১৯ টিকার নিবন্ধন দেয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে রাশিয়া। অনুমোদন পেতে যাওয়া টিকাটি যৌথভাবে তৈরি করেছে দেশটির গামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামীকাল ১২ আগস্টই হতে পারে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দেশটির গবেষকেরা বলছেন, টিকাটির তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে। টিকাটি এতে নিরাপদ হিসেবে প্রমাণিত হলে তা স্বাস্থ্যকর্মী ও দেশের সিনিয়র নাগরিকদের প্রথমে প্রয়োগ করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
আশিক ১১ আগস্ট, ২০২০, ৩:৩১ এএম says : 0
এই অদৃশ্য কারণে আমাদের দেশের অনেক ভালো ভালো বিষয় সংঘটিত হয় না
Total Reply(0)
হাবিব ১১ আগস্ট, ২০২০, ৩:৩২ এএম says : 0
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি
Total Reply(0)
তানিয়া ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:০৫ এএম says : 1
পরের আশায় বসে না থেকে নিজেদের মধ্যে যারা চেষ্টা করছে তাদেরকে সহযোগিতা করা দরকার বলে আমি মনে করি
Total Reply(0)
দুলাল ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:০৬ এএম says : 0
যেই দেশ আগে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করবে তাদের কাছ থেকেই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে হবে
Total Reply(0)
নাবিল ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:০৮ এএম says : 0
ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়
Total Reply(0)
তানিম আশরাফ ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:১০ এএম says : 0
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় আজ আমরা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছি।এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না।
Total Reply(0)
ফারুক সজন ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:১১ এএম says : 0
এটা আমাদের জন্য একটা সুযোগ। কেবল সিদ্ধান্তহীনতার অভাবে এটা হাতছাড়া করা যেতে পারে না।
Total Reply(0)
পারভেজ ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:১১ এএম says : 0
এ ব্যাপারে সরকারের আরো দক্ষতার সাথে কাজ করতে হবে
Total Reply(0)
বাহার শেখ ১১ আগস্ট, ২০২০, ১০:১২ এএম says : 0
অত্যন্ত দু:খজনক বিষয়। এটা আমাদের জন্য লজ্জার ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন