প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে প্রভাবে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে বিরাজ করছে স্থবিরতা। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার প্রভাব পড়েছে আমদানি-রফতানিতেও। করোনার কারণে অর্থনীতির সব সূচকই মন্থর। তারপরও দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বলছে, করোনার মধ্যেও দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই বিনিয়োগ বেড়েছে। যদিও করোনার প্রভাবে অসংখ্য মানুষের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেকার হয়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগ ব্যয় যেখানে কমার কথা বলছে অর্থনীতিবিদরা সেখানে বিবিএস বলছে দেশে মানুষের ভোগব্যয় বাড়ছে। করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে মানুষ যখন জীবন জীবিকার তাগিদে সঞ্চয়পত্র ভেঙ্গে ফেলছে সেখানে বিবিএস বলছে, দেশে গড় সঞ্চপত্রের হার বাড়ছে। সংস্থাটির দেয়া তথ্য মতে, সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। যা গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। তবে করোনার প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমলেও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মানুষের গড় আয় হয়েছে দুই হাজার ৬৪ ডলার। অর্থাৎ প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরলে বার্ষিক আয় এক লাখ ৭৫ হাজার ৪৪০ টাকা। এক্ষেত্রে গড়ে প্রত্যেকের মাসিক আয় ১৪ হাজার ৬২০ টাকা। আগের অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার আয় বেড়েছে।
গত সোমবার রাতে বিবিএসের ওয়েবসাইটে বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, ভোগ ব্যয়, মজুরি খরচসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদায়ী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে, সেগুলো সাময়িক তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ ওই নয় মাসের তথ্য উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে। যখন জুলাই থেকে জুন পুরো এক বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হবে, তখন প্রবৃদ্ধির তথ্য হেরফের হতে পারে।
এর আগে ২০০১-২০০২ অর্থবছরে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত এক দশক ধরে দেশে গড়ে ছয় শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে, দুই বছর ধরে আট শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, করোনার প্রভাবে এক লাফে প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম বলে এক শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য চার শতাংশ বিনিয়োগ হয়। সে অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ওই বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিবিএস বলছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছে মোট জিডিপির ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিবিএসের তথ্য বরাবরাই সন্দেহের উদ্রেক তৈরি করে। সরকারি সংস্থাটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার তাগিদ দেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, করোনার কারণে বিদায়ী অর্থবছরে যদি ৫ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলে বিবিএস, তাহলে সেটাকে বলতে হবে এক মিরাকল অর্থনীতি। দেশে যেখানে আমদানি-রপ্তানিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে, বিনিয়োগ নেই, সেখানে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কীভাবে ৫ শতাংশের ওপরে অর্জিত হয়, তা বোধগম্য নয়। তাহলে বুঝতে হবে বিবিএসের মৌলিক পদ্ধতিতে সমস্যা আছে। করোনার কারণে কীভাবে দেশে অভ‚তপূর্ব শ্রমের উৎপাদনশীল হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সিপিডির এই ফেলো।
এর আগে বিশ্বে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হয়, তখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি আইএমএফসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস দেন। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে দুই থেকে ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছিল প্রবৃদ্ধি হতে পারে দুই শতাংশ। আর সিপিডি বলেছিল, ২ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। সেখানে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ২৪ ভাগ। যদিও বিবিএসের পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই তথ্য সাময়িক। পুরো বছরের তথ্য পেলে এটা বাড়তেও পারে; আবার কমতেও পারে।
যে তিনটি খাতের ওপর ভিত্তি করে জিডিপি নিরূপণ করা হয় সেই তিনটি খাতেই প্রবৃদ্ধি কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা ছিল ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমে ৬ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে এসেছে যা আগের বছর ছিল ৬ দশমিক ২১ শতাংশ। করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেবা খাতে। বিদায়ী অর্থবছরে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। যেটা আগের বছর ছিল ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বিবিএস বলছে, করোনার কারণে খুচরা ও পাইকারি বাণিজ্যে করোনার ধাক্কা ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া হোটেল রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আবাসসন শিক্ষা খাতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে দেশে মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে ২০৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর আগের অর্থবছর অর্থ্যাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার। এখন সেটি দুই হাজার ডলার ছাড়াল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৭৫১ ডলার। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল এবং মাথাপিছু আয় হয়েছিল এক হাজার ৬১০ ডলার।
বিবিএস’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৮ কোটি ২৪ লাখ পুরুষ এবং নারী ৮ কোটি ২২ লাখ। এরা সবাই এখন ১৪ হাজার ৬২০ টাকা করে মাসিক আয় করেন। এর আগের বছরে প্রত্যেকের মাসিক আয় ছিল ১৩ হাজার ৫২২ টাকা। অর্থাৎ করোনাকালেও এক বছরের ব্যবধানে মাসিক আয় বেড়েছে এক হাজার ৯৭ টাকা ৯৭ পয়সা।
বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৮ দশমিক ১২ ভাগ আর বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২৩ দশমিক ৬৩ ভাগ। এর আগের বছর মোট বিনিয়োগ হয়েছিল ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সে হিসেবে আগের বছরের তুলনায় গত বছর বিনিয়োগ বেড়েছে। গত বছর ভোগ ব্যয় হয়েছে মোট জিডিপির ৭৪ দশমিক ৬৯ ভাগ। মোট সঞ্চয়পত্র হয়েছে জিডিপির ৩০ দশমিক ১১ ভাগ। যেটা আগের বছর ছিল ২৯ দশমিক ৫০ ভাগ।
এদিকে করোনার কারণে দেশে রফতানি কমেছে দুই দশমিক ১৪ শতাংশ। রফতানির পাশাপাশি আমদানিও কমেছে। এর পরিমাণ এক শতাংশের কম (দশমিক ৫১)। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে রফতানির পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দারুণ উন্নতি হয় রফতানিতে। এ সময় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ রফতানি হয়। অর্থাৎ বিদায় অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় রফতানি কমেছে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশ আমদানির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাপক আমদানি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৭ দশমিক ০১ শতাংশ। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি কমে হয় ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি কমে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি কমেছে দশমিক ৫১ শতাংশ।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন