গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার জের ধরে বাসাবাড়ি ও মেসে তল্লাশি ও ব্লক রেইড রাজধানীসহ সারা দেশে জনমনে একধরনের ভীতি এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ এক অজানা আতঙ্কে আছে। গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার বাড়িতে বা মেসে এসে হানা দেয়, বলার উপায় নেই। অনিশ্চিত এই তল্লাশি অভিযানের আতঙ্ক নিয়েই বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা এখন বসবাস করছেন। অনেকে বিড়ম্বনারও শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে মেসে যারা বসবাস করেন। তারা না পারছেন থাকতে, না পারছেন যেতে। অনেকে ভাসমান হয়ে পড়েছেন। যদিও ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ব্যাচেলরদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়া-না দেয়ার ব্যাপারে মালিকদের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে অনেকে মনে করছেন, পুলিশের অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে মালিকরা ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন। এমনকি যারা বাসা ভাড়া করে আছেন, এমন অনেককে বাড়ির মালিক বাসা ছাড়ার নোটিশও দিচ্ছেন। এতে অসংখ্য মেস ও বাসা থেকে ভাড়াটিয়াদের চলে যেতে হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, চাকরিপ্রার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ চরম বিপাকে পড়ছেন। গতকাল বেশ কয়েকটি দৈনিকে পুলিশের অভিযান নিয়ে ভুক্তভোগীদের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অভিযানের ধরন দেখে তাদের মনে হয়েছে যে, কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াই পুলিশ ঢালাওভাবে অভিযানে নেমেছে। তারা বলেছেন, সঠিক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালালে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে অভিযানের নামে তাদের কেন হয়রানির শিকার হতে হবে? জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, এভাবে অভিযান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, একদিকে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান তল্লাশি অভিযান, জনমনে বহুগুণে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, তবে তা জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে ও হয়রানি করে নয়।
আমরা অতীতে দেখেছি, যে কোনো আইনশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর অতিউৎসাহী সদস্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করতে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে পুলিশ যে জনগণের বন্ধু এবং তাদের সহায়তা করার জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত, মহান এই কর্তব্যের কথা সাধারণ মানুষ মনে করতেও পারে না। একশ্রেণীর পুলিশের আতঙ্কজনক আচরণ দেখে গোটা পুলিশ বাহিনীর প্রতি তাদের এরূপ ধারণা জন্মেছে, পুলিশ মানেই বিপদের আশঙ্কা। মেস ও বাসা-বাড়িতে সাম্প্রতিক অভিযান মানুষের এ আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শঙ্কা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সবসময় যদি আতঙ্কেই থাকতে হয়, তবে কাজ-কর্ম করবে কিভাবে? এ পরিস্থিতিই যেন এখন চলছে। মেস করে যেসব শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, চাকরি সন্ধানকারী, বিভিন্ন পেশার মানুষজন বসবাস করেন, তাদের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। এমনিতেই ব্যাচেলরদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না, তার উপর যদি তারাই মূল টার্গেট হয়, তবে দুর্দশা অবধারিত হয়ে উঠে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সর্বক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য। শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যাহত, চাকরিজীবীর ভোগান্তি, চাকরি সন্ধানকারীর বেকারত্ব দীর্ঘায়িত হওয়া, মেস ও বাসার মালিকদের আর্থিক ক্ষতিসহ নানামুখী সংকট অবধারিতভাবে সৃষ্টি হবে। এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে মূল সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। দেশের মানুষ তো বটেই বিদেশিরা পর্যন্ত এ সংকটে ভুগছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, এদেশে কর্মরত বিদেশিদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিজ দেশে চলে গেছেন। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মক্ষেত্র সীমিত করে এনেছে। যুক্তরাজ্য পুনরায় বড় ধরনের হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করে তার নাগরিকদের সতর্ক ও নিরাপদ দূরত্বে থেকে চলাচল করার পরামর্শ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই ধরনের পদক্ষেপের কথা বলেছে। প্রত্যেকেই নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের আস্থার সংকটে ভুগছে। এ পরিস্থিতিতে পুলিশের অভিযান, তল্লাশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের হয়রানি পুরো পরিবেশকে আতঙ্কে রূপ দিয়েছে। যেসব এলাকায় অভিযান হয়নি, সেসব এলাকার বাসিন্দারাও অভিযানের কথা শুনে হয়রানির আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়ছেন। গুলশানে জঙ্গি হামলার পর গত ২০ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৬০টি ব্লক রেইড চালিয়েছে পুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ব স্ব এলাকার বাসিন্দারা এক ভীতিকর তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, সরকারের পুরো মনোযোগ এখন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী পাকড়াওয়ের দিকে। এদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে উন্নয়নের বিষয়টি ঢাকা পড়ে গেছে। সরকারের নেয়া ফার্স্ট ট্র্যাক বা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুতসম্পন্ন করার জন্য প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে তেমন কোনো খোঁজ নেই। একমাত্র পদ্মা সেতুর অগ্রগতি সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়। এতে প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সরকারের উন্নয়নের ফলক নির্দেশ করতে পারে এমন প্রকল্পগুলোর কাজ স্থবির হয়ে পড়ছে। শুধু এসব উন্নয়ন প্রকল্পই নয়, সার্বিক অর্থনীতি এক ধরনের মন্দাবিষ্টতার মধ্যে রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে উঠেছে। বিদেশে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশি বিনিয়োগকারীরা বিদেশে কারখানা গড়ে তুলছে। গার্মেন্টস খাত বহুদিন ধরেই ঝুঁকির মধ্যে। শত শত কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানি কয়েক বছর ধরেই স্থবির হয়ে রয়েছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে। সাধারণ মানুষের জীবনে টানাপড়েন দিন দিন বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গি হামলা এবং তা দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্লক রেইড ও তল্লাশি অভিযানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিতভাবেই অর্থনীতিসহ সব কিছুর ওপরই পড়ছে মানুষ যদি স্বাভাবিক ও নিঃসংকোচে চলাফেরা করতে না পারে, তবে অর্থনীতির চাকা শ্লথ হবেই। অথচ অভিযান এমন হওয়ার কথা, যেখানে মানুষ হয়রানির শিকার না হয়ে এবং নিরাপত্তাহীনতায় না ভুগে আশ্বস্ত হবে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক হবে। গতকালের একাধিক পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে আমরা যা দেখেছি, তাতে এটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার পরিবর্তে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের সাথে আসামির মতো আচরণ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর অতিউৎসাহী সদস্যর কারণে যে জনমনে এ ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে, তা বোধ করি বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ নেই।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এ কথা বহুবার বলেছেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা যে রূপ পরিগ্রহ করছে, তা সরকারের একার পক্ষে বা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন, দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য। সরকার তা আমলে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভর করে তা সামাল দেয়ার পথে এগুচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য কর্তৃক সাধারণ মানুষ রাস্তা-ঘাট ও বাসা-বাড়িতে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ শ্রেণীর সদস্য যে প্রকারন্তরে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ ও তাকে বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে, তা তাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এমন কথাও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে উঠছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে এবং এ ব্যর্থতা ঢাকতে অভিযানে নেমেছে। সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। মানুষের মনের এ পারসেপশন সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা মনে করি, এ বিষয়গুলোর প্রতি সরকারের যথাযথ দৃষ্টি দেয়া উচিত। সতর্কতার সাথে এমন পদক্ষেপ উচিৎ, যাতে সাধারণ মানুষ কোনো ধরনের হয়রানির শিকার এবং অপদস্ত না হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন