শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পদ্মাপারের মানুষই বেশি গুরুত্বপূর্ণ

| প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

পদ্মাসেতুর চেয়ে পদ্মাপারের মানুষ অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মাসেতুর প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ অস্বীকার করেনা। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মাসেতু রাখতে পারে অসামান্য অবদান। কিন্তু যে মানুষের জন্য পদ্মাসেতু, সেই মানুষ উপেক্ষিত থাকতে পারেনা। পদ্মায় একটি সেতু হচ্ছে। আরো একটি সেতুর পরিকল্পনা আছে। অথচ পদ্মার ভাঙন থেকে জনপদ রক্ষার জন্য কোনো ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা নেই। চলমান বন্যায় পদ্মার ভাঙনে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারিপুর, চাঁদপুর প্রভৃতি এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদ, বাড়িঘর, স্থাপনা, সড়ক ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। এখনো পদ্মা বেপরোয়াভাবে দুই তীর ভাঙছে। এমন কি পদ্মা সেতুও ভাঙনের হুমকিতে পতিত হয়েছে। পদ্মা পৃথিবীর তীব্র গতিশীল নদীগুলোর একটি। ভাঙনপ্রবণ নদীগুলোর মধ্যে তার স্থান শীর্ষে। পদ্মাকে বলা হয়, ‘সর্বনাশা, ‘কীর্তিনাশা’। এ যাবৎ কত মানুষ যে তার সর্বনাশের শিকার হয়েছে, কত কীর্তি যে তার বুকে লীন হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ বছর তো বটেই, গত একশ’ বছরেরও বেশি সময়ের তথ্যমতে, পদ্মাপারের মানুষ সবচেয়ে বেশী ভাঙনের শিকার হয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিংগার নেচারে গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০৫ বছরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে দুই পারের ১৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। আর একই সময়ে পলি পড়ে গড়ে উঠেছে ১৩১৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই ভাঙাগড়ার খেলায় পদ্মাপারের মানুষেরা ভূমি হারিয়েছে ৪৩৩ বর্গকিলোমিটার ।

নদী একূল ভাঙে ওকূল গড়ে সত্য, কিন্তু ভাঙনে যারা বাড়িঘর, জমিজিরাত, বৃক্ষ-বাগান হারায় তারা চিরতরেই তা হারায়। নদীর ওপারে জমি জেগে উঠলেও তারা সেটা পায় না। অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে নদীভাঙনের বিপর্যয়ের পার্থক্য এই যে, নদীভাঙনে সবকিছুই শেষ হয়ে যায়। মানুষ নি:স্ব, উদ্বাস্তু ও ফকির হয়ে যায়। পদ্মা শত শত বছর ধরে এভাবে কত মানুষকে যে পথে বসিয়েছে, কাঙালে পরিণত করেছে, তার হিসাব নেই। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানায়, ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬৬ বছরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে ৬৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা, যা ঢাকা শহরের আড়াই গুণের সমান। শুধু পদ্মা নয়, দেশের অন্যান্য বড় নদী যথা-মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ইত্যাদিসহ ছোট নদীগুলোও খুবই ভাঙনপ্রবণ। এসব নদীর ভাঙনে প্রতিবছর কত ভূমি-জনপদ যে ধ্বংস হয়ে যায়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। গবেষকদের মতে, বন্যা ও উজান থেকে আসা বিপুল পলিই নদীভাঙনের জন্য প্রধানত: দায়ী। বাংলাদেশে বন্যা মোটেই নতুন কোনো বিষয় নয়। ভূ-প্রাকৃতিক কারণে বন্যা অবশ্যম্ভাবী। বৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা ঢলই বন্যার কারণ। সম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, অভিন্ন নদীর উজানে নির্মিত বাঁধের গেট ভারত বর্ষার সময় একযোগে খুলে দেয়। ঠেলে দেয়া এই পানি বন্যা ও নদীভাঙনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। পলি যে নদীভাঙনের অন্যতম কারণ, তারও মূলে আছে বাঁধ দিয়ে ভারতের নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার। শুকনো মওসুমে নদীর স্রোতপ্রবাহ কম থাকায় স্রােতবাহিত পলি নদীর বুকেই জমা হয়। এভাবে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় নদী বর্ষায় বিধ্বংসী রূপ নিয়ে ভাঙনের তান্ডব চালায়। নদীভাঙন রোধে অনেক নদীরই দুই পারে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধের বেশীর ভাগই নদীর সঙ্গে প্লাবনভূমির সম্পর্কোচ্ছেদ ঘটিয়েছে। নদীর বুকে পলি জমার এটাও একটা কারণ।

নদীভাঙন রোধে একটি ব্যাপকভিত্তিক বা সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বহুদিন ধরে উচ্চারিত হলেও যথাযথ কার্যোদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। শতবর্ষী ডেল্টা ম্লান অন্যান্য ক্ষেত্রের মত নদীভাঙন রোধেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কবে এই প্লানের কার্যক্রম শুরু ও শেষ হবে, বলার উপায় নেই। এদিকে ভাঙন ও ভূমিধ্বংস দিনকে দিন বাড়ছেই। আমরা বছরের পর বছর দেখে আসছি, কোথাও নদী ভাঙন দেখা দিলে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। কখনো এ চেষ্টা সাময়িকভাবে সফল হয়, কখনো হয় না। নদীভাঙনরোধক যেসব বাঁধ দেয়া হয়েছে, তাও টেকসই নয়। অল্প আঘাতেই বাঁধ ধ্বসে যায়। এভাবে ভঙ্গুর বাঁধ দিয়ে কিংবা বালির বস্তা ফেলে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়। প্রতি বছর এভাবে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, তা আসলে অপচয় হয়ে যায়। পদ্মার চলমান ভাঙন অস্থায়ীভাবে ঠেকাতে এর মধ্যেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। গোটা দেশের নদীভাঙন ঠেকাতে এপর্যন্ত কত খরচ হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডই বলতে পারবে। স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তৃপক্ষ ও প্রকৌশলীরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বাঁধ নির্মাণ, মেরামত, সংস্কার, ভাঙন ঠেকানোর অস্থায়ী ব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্যে বড় ধরনের ‘বাণিজ্য’ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে নদীভাঙনের ক্ষতি ঠেকানো যাবে না। কাড়ি কাড়ি টাকা কেবল পানিতে ফেলা হবে। নদীভাঙন রোধে টেকসই কার্যব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বের ভাঙনপ্রবণ বিভিন্ন নদী শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। একদা ভাঙনপ্রবণ হোয়াংহো, টেমস্, রাইনের তীরে এখন বিখ্যাত নগরী ও জনপদসমূহ শোভা পাচ্ছে। সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে কাজে লাগানো হচ্ছে। আমরাই কেবল উপযুক্ত উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে নদীভাঙন রোধ করতে পারছি না। নদীভাঙন রোধক পরিকল্পনা, ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি এমনকি প্রয়োজনীয় সহায়তা এখন দুলর্ভ নয়। প্রয়োজন যথার্থ উদ্যোগ। সেই উদ্যোগই এখন সবচেয়ে বেশী দরকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন