মেঘনানদী, এখন এক ভয়ংকর আতংকের নাম,এই নদীর নাম শুনলেই নদী পাড়ের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ চমকে উঠে। রাক্ষুসে মেঘনার ভয়াল থাবায় ক্ষত-বিক্ষত রামগতি- কমলনগরের বিস্তীর্ন জনপদ। যে নদী দেশের কথা মনে করায়, স্বজনের কথা মনে করায়, বিশাল উদাত্ত জলরাশি আর খোলা আকাশ মনে মায়ার জন্ম দেয়। নদী আমাদের দেশ ও মানুষের মায়ার জননী। তারপরও নদী আমাদের সব কিছু নিয়েই চলেছে। কিন্তু সেখানে এখন আর তেমন কিছুই নেই। সেই জায়গাটিতে শুধু রয়েছে স্মৃতি। বহু স্মৃতি হারিয়ে গেছে নদী গর্বে। যাদের আর কিছুই বাকি রইলনা। ঠাইও নাই তাদের। আজ সেই সর্বহারা মানুষগুলোর আছে শুধু হাও-মাও কান্না। সে কান্না শোনা যায় লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার কিছু কিছু এলাকায়।
বিশ্বের মানচিত্রে যে দিন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ঠিক সেদিনই বাংলার মানচিত্রে জন্ম হয়েছে লক্ষ্মীপুরে রামগতির ও। আর রামগতি থেকে ভাগ হয়ে হয় আরো একটি ক্ষুদ্রতম উপজেলা কমলনগর। এই দুটি উপজেলায় আছে কলেজ, মাদ্রাসা, স্কুল ও উচ্চ শিক্ষার বিদ্যাপিট। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে গিয়ে যাঁরা বাংলাদেশ পরিচালনা করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তাদেরি মাতৃভূমি রামগতি ও কমলনগর আজ মেঘনার করাল গ্রাসে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বহু মানুষ তাদের সবকিছু হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিছে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বহু যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক কাঠামো কাঁচের টুকরোর মত ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এক সময় যাদের কয়েকশ’ একর জমির মালিক ছিলো এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য যারা বিপুল পরিমাণ জমি দান করেছেন, এখন তাদের অন্যের জমিতে ঠাঁই নেয়। ভিটেমাটি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে জীবনের গতিপথও। আর এ জীবিকার অবলম্বন থেকে পারিবারিক ঐতিহ্য, এমনকি সামাজিক কাঠামো অথবা শিশু-কিশোরদের লেখাপড়া পর্যন্ত।
সূত্র জানান, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা তীরের উপজেলা কমলনগর এভাবেই বদলে যাচ্ছে। কোথাও ভাঙনের গতি কিছুটা কমলে আবার কোথাও বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। এসব এলাকার বহু ঐতিহ্যবাহী পরিবারের পুরানো ভিটে এখন মেঘনার বুকে। বাপ-দাদার শত শত একর জমি থাকলেও এখন তারা পথে বসেছে। পূর্বপুরুষের বিপুল সম্পত্তির মালিকানা এখন তাদের কাছে শুধুই ইতিহাস। মেঘনা শুধু তাদের ভিটেমাটি ভাঙছেনা, ভাঙছে তাদের হ্দৃয়।উপজেলার মতিরহাট থেকে চরফলকন পর্যন্ত নদীপথ ঘুরে দেখা গেছে, শুধু ধ্বংসের চিত্র। মেঘনা নদীর প্রতিনিয়ত ভাঙ্গনে হেলে পড়েছে গাছপালা, ফসলী জমি ও বাড়িঘর। উপকূলীয় মেঘনার পাড়ের সর্বস্ব হারানো মানুষের মাঝে শুধু চাপা আর্ত্ননাদ। লক্ষ্মীপুরের ক্ষুদ্রতম উপজেলা এই কমলনগর। এর আগেও তিনবার ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে বহু জনপদ। এবার নিয়ে চতুর্থবারের মতো ভাঙছে এই জনপদ। ভাঙনের পর মেঘনা অববাহিকায় পলি জমে আবার মাথা তোলে ভূক্ষ। স্বপ্ন জাগায় মানুষের মনে। চর ফলকন ইউনিয়ন আর পাটোয়ারিহাট ইউনিয়নের সীমায় ঐতিহ্যবাহী লুধুয়া বাজার। বেশ জমজমাট বাজার ছিলো। পাশে মাছ ঘাটের কারণে এ বাজার জেগে থাকতো রাত-দিন। কিন্তু এ বাজার এখন আর নেই। লুধুয়া বাজার রক্ষা নিয়ে এখন যে শঙ্কা ছিলো, সেই শঙ্কাই ছিল বাতির খাল, কিংবা সাহেবের হাট নিয়ে। ওইসব বাজারের শেষ রক্ষা হয়নি। কোনোটি একেবারেই নি:স্ব হয়ে গেছে। আবার কোনোটি পিছু হটতে হটতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মানে স্থান বদলের আর কোনো জায়গা নেই। কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট, লুধুয়া, চরফলকন ও চরজগবন্ধুসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন বহু চিত্র পাওয়া যায়।
স্থানীয় লোকজন জানান, ভাঙনের প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে। জীবিকার ধরন বদলে গেছে। নদী-নির্ভর জীবিকার কারণে অনেকেই নদীর কিনারে থাকতে চান। কেউ পারেন। আবার কেউ পারেন না। ফলে জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে তাদের ছুটতে হয় শহরে। গত কয়েক বছরে এ উপজেলা থেকে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে স্হানীয়দের সাথে কথা বলে জানাযায়, ভাঙনের প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। পরিবার স্থানান্তরিত হওয়ায় বহু ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে আবার একই ক্লাসে ২-৩ বছর থেকে লেখাপড়ায় অগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। লুধুয়া ফলকন ফয়জুন্নাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর দেখা মেলে। ফলকন, কালকিনি, সাহেবেরহাটে পথে যেতে দেখা হয় এমন আরও কয়েকজন শিশু-কিশোরের সঙ্গে।
সূত্রে আরো জানা যায়, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চর এই অঞ্ছলের বয়স প্রায় দেড়শ’ বছর। এখানকার জনবসতি প্রায় একশ’ বছরের। পুরোনো ভোলার শাহবাজপুর, রামদাসপুর, নেয়ামতপুর, নোয়াখালীর কুশখোলা, ফরাশগঞ্জ, ভুলুয়া ও হাতিয়া এলাকা থেকে জনবসতি গড়ে তোলে এই এলাকা গুলোতে। বংশ পরম্পরায় শত বছরে এ বিস্ততি ঘটে গোটা কমলনগর জুড়ে। কিন্তু এখন তা ভাঙনের মুখে। বছরে বছরে এই জনপদ ছোট হয়ে আসছে, আর এখানকার মানুষের ছুটছেন এদিক ওদিক।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে শত বছরের পুরোনো কয়েকটি বাজার ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে এসব বাজারের শত বছরের পুরোনো মসজিদ, সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা। নদীভাঙনের প্রভাব সবচেয়ে বেশী পড়ে উপকূলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিদ্যালয় জায়গা স্থানান্তরিত হলে ঝরে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী।সূত্র মতে, মেঘনার ভাঙন রোধে সরকার ইতোমধ্যে সরকারি বরাদ্দে কাজ হয়েছে রামগতি বাজার এলাকায় ও উপজেলা শহরের আলেকজান্ডার এলাকায়। কিন্তু এ প্রকল্পের মধ্যে কমলনগর উপজেলায় এক কিলোমিটার কাজ করলেও তা নদীর তীব্র ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বেশ কিছু অংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ কারণে নদী ভাঙনের তীব্রতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ভাঙন রোধে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র থেকে কমলনগর উপজেলা হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।কথা হয় কালকিনি এলাকার বাসিন্দা ও স্হানীয় সংবাদকর্মী শাহরিয়ার কামালের সাথে। তিনি হাও-মাও করে কেঁদে ওঠে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমগো এখন যাওয়ার কুনু জাইগা নাই, কই যামু জানিনা, আমাগো ফটু তুইল্যা কি হইবো? কতজনে ফটু তুইল্যা নিলো কিন্তু আমগো ভাইগ্যের কিসু হইলো না” তার অভিযোগ, নির্বাচন এলে নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে কাজ করবে বলে বহু প্রতিশ্রুতি দেয় জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর আর কোন খোঁজ খবর রাখেনা তারা।
কমলনগর নদী শাসন সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আব্দুল মোতালেব দৈনিক ইনকিলাবকে কে জানান, যদি এভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ দুই উপজেলার ২ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে। ভিটে মাটি রক্ষায় প্রতি নিয়ত মানববন্ধন বিক্ষোভসহ বিভিন কর্মসুচি পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু কোন কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। দ্রুত দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবী করেন তিনি।কমলনগর নদী শাসন সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব ও কমলনগর প্রেসক্লাবের সভাপতি এম এ মজিদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, গত ১৫ দিনে ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে নিঃস্ব হয়েছে তিন শতাধিক মানুষ। এ ভয়াবহ ভাঙ্গন এর আগে দেখেনি তারা। ভাঙ্গন প্রতিরোধ ও বাঁধ নির্মানের দাবীতে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর-৪ রামগতি-কমলনগর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, মেঘনা নদীর ভায়াবহ ভাঙন থেকে কমলনগর উপজেলাকে রক্ষায় ‘কমলনগর-রামগতি মেঘনার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের’ আওতায় একনেকে ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে রামগতি বাজার এলাকা, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন আলেকজান্ডার ও কমলনগর উপজেলায় নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভাঙ্গন রোধে সরকার আরো বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার কিছু কাজ চলমান রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমেদ ভয়াবহ ভাঙ্গনের কথা স্বীকার করে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে কিছু এলাকায় বাঁধের কাজ চলছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন